‘ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে সেদিন ছিল আমার প্রথম রাত। আমার চোখের সামনেই তিনটা বাচ্চা মারা গেল। এত অসহায় লেগেছিল আমার ওইদিন, আমি কান্না করে দিয়েছিলাম’।
সে আরও ২১ বছর আগের কথা। ডাঃ মো: জোবায়ের চিশতী সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগে নিজের ডিউটি দিচ্ছিলেন। ওইদিন রাতেই নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শিশুদের নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে কিছু একটা তাকে করতেই হবে।
অবশেষে দুই দশকের গবেষণা শেষে ডাঃ চিশতী তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকায় বছরে প্রায় ৯ লাখ ২০ হাজার শিশু মারা যায় যে রোগে, সেই নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন তিনি, তাও আবার শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে!
স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ফুসফুস সংক্রমিত হলে, কিংবা RSV ভাইরাস (Respiratory Syncytial Virus) দ্বারা আক্রান্ত হলে শিশুরা নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে ফুসফুস স্ফীত হয়ে যায়, এবং প্রচুর ফ্লুইড দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে অক্সিজেন গ্রহণ করতে সমস্যা হয় রোগীদের।
উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালগুলো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই একেকটি মেশিনের দাম পড়ে প্রায় ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, দক্ষ লোকবল ছাড়া এই মেশিন চালানোও সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের হাসপাতালগুলোর জন্য এটি খুবই খরচসাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া, যে কারণে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বিকল্প হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘লো-ফ্লো অক্সিজেন’ নামের তুলনামূলক সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিল, কিন্তু তাতেও প্রতি সাত জনে একজন শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না।
মেলবোর্নে কাজ করতে গিয়ে একটি মেশিন দেখে ডাঃ চিশতী অনুপ্রেরণা পান। ‘Continuous Positive Airway Pressure’ (CPAP) পদ্ধতিতে ফুসফুসকে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছিল, শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনও সরবরাহ করা যাচ্ছিল। কিন্তু এই পদ্ধতিটিও খুব ব্যয়বহুল ছিল।
বাংলাদেশে ফিরে তাই তিনি সাশ্রয়ী CPAP ডিভাইস বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। একজন সহকর্মীর সাথে মিলে তিনি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) থেকে একটি পরিত্যক্ত শ্যাম্পুর বোতল জোগাড় করে নিয়ে আসেন। বোতলটি পানি দিয়ে পূর্ণ করে এক প্রান্তে কিছু প্লাস্টিক সাপ্লাই টিউব জুড়ে দেন।
এটা কিভাবে কাজ করে জানতে চাইলে ডাঃ চিশতী বলেন, ‘শিশুরা একটি ট্যাঙ্ক থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে, আর একটি টিউবের মধ্য দিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। সেই টিউবটি ওই পানি ভর্তি বোতলের ভেতরে ঢুকানো থাকে, আর ওই বোতলের ভেতর গিয়ে বুদবুদ সৃষ্টি করতে থাকে’। এই বুদবুদ থেকে যে চাপ সৃষ্টি হয়, সেটিই ফুসফুসের ছোট ছোট বায়ু কুঠুরিগুলোকে সচল রাখে।
‘চার পাঁচজন রোগীর উপর শুরুতে একটা ছোট পরীক্ষা করলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দারুণ উন্নতি লক্ষ্য করলাম আমরা’।
সফলতার গল্প:
কোহিনুর বেগমের মেয়ে রুনা এই চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়েই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কোহিনুর বেগম জানিয়েছেন, ‘ডাক্তারেরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে তুলতে। প্রথমে অক্সিজেন দেয়া হল, তারপর একটা পাইপ দিয়ে খাবার দেয়া হল, আর তারপর একটা সাদা গোল বোতল লাগিয়ে দিল। চিকিৎসার পর যখন আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল, আমি যে কি খুশি হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না’।
দুই বছরের গবেষণার পর ডাঃ চিশতী তার গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেন ল্যাঙ্কেট ম্যাগাজিনে। গবেষণায় তিনি দেখান, এই ‘Bubble CPAP’ চিকিৎসায় শিশুমৃত্যুর হার ‘লো-ফ্লো অক্সিজেন’ পদ্ধতিতে শিশু মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক গুণ কম। মাত্র ১.২৫ ডলার খরচায় এই পদ্ধতিতে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা গেছে প্রায় ৭৫%।
এই পদ্ধতিতে হাসপাতালের অক্সিজেন খরচও অনেকটা সাশ্রয় করা গেছে। আগে যেখানে অক্সিজেনের বিল আসত ৩০ হাজার ডলার, এখন সেখানে আসছে ৬ হাজার ডলার।
আদ-দ্বীন উইমেন’স মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের প্রফেসর ড: এ.আর.এম লুৎফুল কবির জানিয়েছেন, দেশজুড়ে এই ব্যাপারে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে এখনো পর্যন্ত যা ফলাফল এসেছে, তা খুবই আশাব্যঞ্জক।
২১ বছর আগের প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পেরে ডাঃ চিশতী যে কতটা খুশি, সেটা বোধহয় আর নতুন করে না বলে দিলেও চলবে!
বিবিসি নিউজ অবলম্বনে