দিন দিন শোবিজের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তথাকথিত সাসপেন্স, সস্তা বিনোদন, বাহুল্য নাটকীয়তা আর চটকদার সব সংবাদ। কথাটি আমার ব্যক্তিগত মতামত নয়। বাংলাদেশের বিনোদন জগতের টুকটাক খবরাখবরও যারা রাখেন, তারা অন্তত গত এক সপ্তাহ ধরে পত্রিকায়, টেলিভিশনে আর অনলাইনে অসংখ্যবার এর প্রতিফলন দেখতে দেখতে এতদিনে নিশ্চয়ই ত্যক্ত হয়ে উঠেছেন। বলা হচ্ছিল, ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭’ প্রতিযোগিতার বিজয়ীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রিউমার আর হিউমারের কথা। খ্যাতনামা ইউটিবার সালমান মুক্তাদিরের ভাষায় পুরো ঘটনাটিই ছিল সস্তা প্রচারণার একটি অংশ।
সবকিছু বেশ ঠিকঠাকই চলছিল। কে জানতো শেষে গিয়ে এমন একটা গোলমাল বাঁধবে? ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার শীর্ষ ১০ প্রতিযোগীর মধ্যে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন ভারতীয় উপস্থাপিকা শিনা চৌহান। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজকরা জানান, তিনি হয়েছেন দ্বিতীয় রানারআপ। পরবর্তীতে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাঁধভাঙা আনন্দে ভাসলেন চট্টগ্রামের এই তরুণী।
অপরদিকে অপ্রস্তুত কাকে বলে হিমিকে দেখে তখন ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। উপস্থাপক ভারতীয় মডেল-অভিনেত্রী শিনা চৌহানের মুখে নিজের নাম সেরা হিসেবে শুনে খুশির ফোয়ারা ছড়িয়েছিল তার মুখে। চীনে আগামী ৩০ ডিসেম্বর বিশ্বসুন্দরীর মঞ্চে উঠবেন ভেবে আনন্দে আপ্লুত ছিলেন হয়তো। কিন্তু তা স্থায়ী হলো মাত্র কয়েক মুহূর্ত। মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ হওয়ার আনন্দটা তার নিমিষেই উড়ে গেলো! তখন দ্বিতীয় রানারআপ হলেও তিনি যে জোর করে মুখে হাসি রেখেছিলেন তা বলে দিচ্ছিল তার চোখমুখ।
‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭’ প্রতিযোগিতার আয়োজক অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী বললেন, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে। মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ হয়েছেন জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল’। এরপর তিনি জানান, প্রথম রানারআপ জেসিয়া ইসলাম ও দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। তার এ ঘোষণা শুনে থতমত খেয়েছেন আমন্ত্রিত অতিথি থেকে শুরু করে স্বয়ং বিচারকরাও। চমকে যাওয়া নাকি হতভম্ব হওয়া, কোন অনুভূতি তারা প্রকাশ করবেন তা তাদের চেহারা দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।
বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির নবরাত্রি মিলনায়তনে গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালেতে এ ঘটনা ঘটে। ভুল বোঝাবুঝির অবসানের পর মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয় এভ্রিলের মাথায়। এ ভুলের কারণে মিলনায়তনে অতিথিদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, অবিশ্বাস ও হাস্যরস। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বয়ে চলেছে ঝড়। জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল সত্যিই বিচারকদের রায়ে সেরা হয়েছেন কিনা তা নিয়ে অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ভুলক্রমে প্রথমে হিমির নাম ঘোষণা করা না হলে হয়তো এমন পরিস্থিতি হতো না। মজার বিষয় হলো, দু’জনেরই নামের শুরুর অংশ ‘জান্নাতুল’। সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিগত বিষয়াদি টেনে এনে, প্রতিযোগিতার নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে তাকে হটিয়ে বিজয়ীর মুকুট মাথায় পরেছেন প্রথম রানার্স আপ জেসিয়া ইসলাম।
আগে যখন এ ধরনের প্রতিযোগিতাগুলো শুধুমাত্র টেলিভিশনের পর্দায় সীমাবদ্ধ থাকতো, তখন আয়োজকদের প্রচারণা বা নাম কেনার জন্য কোনো শর্টকাট খুঁজতে হতো না। কিন্তু এখন ইউটিউবের কল্যাণে দিনকে দিন ভিউ বাড়ানোর জন্য এ ধরনের গোলমেলে অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আয়োজকরা একবার দোষ দিচ্ছেন উপস্থাপিকা শিনাকে, তো আরেকবার বলছেন সময় স্বল্পতার কারণে নামে ভুল হয়ে গেছে। বিজয়ীর নামটাও ঠিকমতো না বলতে পারার মতো সময় স্বল্পতা থাকলে লাইভ প্রোগ্রাম করার দরকারটাই বা কি? আর যদি উপস্থাপিকার কথা বলা হয়, বাংলাদেশে মুনমুন, ফারজানা ব্রাউনিয়া, শারমিন লাকীর মতো উপস্থাপিকারা থাকতেও ভারতের উপর নির্ভরশীল হওয়া কি বাহুল্য নয়? তবে শিনা চৌহানের যোগ্যতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে, এমন জায়গা তিনি রাখেননি। আসল গণ্ডগোলটা যে কী ছিল তা খোদ আয়োজকরাই ভালো জানেন।
শুধু বাংলাদেশেই না, গোটা বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এই এক ট্রেন্ড। টানটান উত্তেজনার মধ্যে লাস ভেগাসের দি এক্সিস থিয়েটারে মিস ইউনিভার্স-২০১৫ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা অনুষ্ঠানকে শুধু টানটান উত্তেজনার বললেও কম বলা হবে; বরং বলা ভালো নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ! কারণ, উপস্থাপক স্টিভ হার্ভে ভুল করে ২০১৫ সালের মুকুটজয়ী হিসেবে মিস কলম্বিয়া আরিয়াদনা গুতিইয়েরেজের নাম ঘোষণা করে ফেলেন। যদিও কিছুক্ষণ পরই নিজের ভুল তিনি স্বীকার করেন এবং প্রকৃত বিজয়ী মিস ফিলিপাইনের নাম ঘোষণা করেন। এ ঘটনার জন্য শুধু উপস্থাপকই নন, আয়োজকদের পক্ষ থেকেও পরে ক্ষমা চাওয়া হয়।
আসলে মিস কলম্বিয়া আরিয়াদনা হয়েছেন ফার্স্ট রানারআপ। আর মিস ইউনিভার্স হয়েছেন মিস ফিলিপাইন পিয়া আলোনজো উরজবাক। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সমালোচনার ঝড় বইছে। এ খবর জানিয়েছে বিবিসি। #MissUniverse2015 হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইটারে কৌতুক করা হয়েছে আয়োজকদের এই মস্ত বড় ভুল নিয়ে। কানাডা থেকে মার্ক ক্রিচ লিখেছেন, ‘অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ মিস-ইনফরমেশন’। অর্থাৎ এবারের বিজয়ী বিভ্রান্তি।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকও এই ভুলের সমালোচনায় ছেয়ে গেছে। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার অফিশিয়াল পেজে নিজেদের ভুল স্বীকার করে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। ৬৪তম মিস ইউনিভার্স ক্রাউন জয়ী মিস ফিলিপাইনের ভক্তরাও কর্তৃপক্ষের এ রকম ভুলের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই ভুলের জন্য নিজের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক স্টিভ হার্ভে। কারণ, মূল মঞ্চে তিনিই ভুল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেছিলেন। নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে স্টিভ হার্ভে লিখেছেন, ‘আমি মিস কলম্বিয়া ও মিস ফিলিপাইনের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী এ ধরনের মারাত্মক ভুলের জন্য’।
এরপর আসা যাক এবছরের অস্কারের ঘটনায়। অস্কারের আসরে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরি। এজন্য সবার শেষে দেয়া হয় এই পুরস্কার। সবার মনে এক প্রশ্ন, কার ঘরে উঠবে সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরির পুরস্কার। আর এবারের আসরে সেই ক্যাটাগরি নিয়েই হলো ভুল। এবারের আসরে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে মুনলাইট। অথচ প্রথমে নাম ঘোষণা করা হয়েছিলো লা লা ল্যান্ডের। ছবির কলাকুশলীরা তখন স্টেজে উঠে আসে।
তখন ওয়ারেন বেটি নিজের ভুল স্বীকার করে বলেন, আসলে পুরস্কার জিতেছে মুনলাইট। তিনি বলেন, আমি যখন খামটি তুলি তখন দেখি লা লা ল্যান্ডের জন্য এমা স্টোনের নাম লেখা। এজন্যই ভুল হয়। পরে ভুল সংশোধন করে মুনলাইট এর নাম ঘোষণা করা হয়। তবে এই ভুলে চমৎকার এই আয়োজনের শেষটা রঙিন হলোনা। এজন্য উপস্থাপক জিমি ক্যামেল ক্ষমা চেয়ে নেন।
এই ক্ষমাপ্রার্থনা, জোড়াতালি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করা, প্রতারণা করে কারো মুখের হাসি কেড়ে নেয়া- এই বিষয়গুলো কি দিনদিন মিডিয়ার পেশাদারিত্বের একটি অংশ হয়ে উঠবে? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর দেয়ার কেউ নেই। এরকম তথাকথিত বিভ্রান্তির দোহাই দিয়ে একটি সুস্থ পরিবেশ নষ্ট না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করার দায়িত্ব পালন করা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি আমরা?