ধরে নিন আপনি দাঁড়িয়ে আছেন ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে। চারিদিকে গিজগিজ করা মানুষের মাথা, অজস্র গাড়ীর হর্ন, সাইনবোর্ড থেকে চোখ ঝলসে দেওয়া মাত্রাতিরিক্ত রঙ- এসবের আক্রমণে আপনি যারপরনাই বিরক্ত ও বিধ্বস্ত। এমন সময় চারপাশের আওয়াজ হঠাত গেল মৃদু হয়ে, চারিদিক ভরে গেল নরম গোধূলি আলোয়, কোথা থেকে যেন বইতে শুরু করল একটা মন ভালো করে দেওয়া হাওয়া। সাম্প্রতিক নাটক ‘কথা হবে তো?’ দেখার অভিজ্ঞতা অনেকটা এমনই। চারপাশের অজস্র মেলোড্রামা, আরোপিত স্মার্টনেস, আন্ডারলাইন করে দেওয়া আবেগের ভিড়ে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম, হয়তো এক নিরুচ্চার, শিল্পিত প্রতিবাদও।
সৈয়দ আহমেদ শাওকি পরিচালিত এ নাটক আপাদমস্তক মুড়ে আছে স্নিগ্ধতায়। আহসান হাবীবের কবিতা ‘দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত এ নাটকের কাহিনী আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের খুব চেনা। কিন্তু এ নাটক কবিতাকে উত্তরণ করেও আরো কিছু। এক এপার্টমেন্টের পাশাপাশি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা দুই যুবক যুবতী রাফি ও সেউঁতির গল্প এটা। তাদের ভালোবাসার গল্প যা স্নিগ্ধ করে, শান্তি দেয়। তাদের দেখা হয়ে যায় হঠাৎ করেই, বাইক সার্ভিসের সূত্রে। তারপর তাদের অনেক না বলা অথবা বলতে গিয়েও না বলতে পারা এবং শেষে বলে ফেলা এমন অনেক কথা দিয়েই সাজানো এ নাটক। গল্পটা পরিচিত কিন্তু এ নাটকের বিশিষ্টতা সেই গল্পের উপস্থাপনায়। আর সেজন্যই বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় কাহিনীকার গাউসুল আলম শাওন ও নির্দেশক সৈয়দ আহমেদ শাওকির নাম। কাহিনী বিশদে বলা নিষ্প্রয়োজন, তার জন্য নাটকটা দেখা জরুরী। কারন এ নাটকের আসল শক্তি কাহিনীর মাঝে মাঝে থেকে যাওয়া বাঙময় নীরবতায়।
কিন্তু যাদের কথা বিশদে বলতেই হয় তারা হলেন এ নাটকের অভিনয়শিল্পীরা। মনোজ কুমার প্রামানিকের রাফির কথা মনে থাকবে বহুদিন। একজন অভিনেতার অনেক বড় অস্ত্র তার চোখ। চোখের অভিব্যক্তির অনবদ্য ব্যাবহার করেছেন মনোজ তার অভিনয়ে। মনে থাকবে তার প্রমিত উচ্চারণও। মনে অবশ্যই থাকবে মাসুমা রহমান নাবিলার কথাও। সেঁউতির পরিমিত অভিব্যক্তি, উচ্চকিত না হতে দেওয়া আবেগের উপস্থাপনে তিনি ভীষনভাবে সক্ষম। অসম্ভব স্বাভাবিকতায় পূর্ণ টুনটুনি সোবাহান অভিনীত সেঁউতির মায়ের চরিত্রটিও। মানিয়ে নেওয়া, ধীরে ধীরে একা হয়ে যাওয়া মায়ের চরিত্র রূপায়ন অসাধারণভাবে বাস্তব।
এ নাটকের আর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ তার আবহ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ও সুরারোপিত ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’ কখন যেন হয়ে উঠেছে নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অনেক পুরনো একটি গানের কি দারুণ ব্যবহার। তবে সব কিছুর উপরে মুগ্ধ করেছে নাটকের আশ্চর্য পরিমিতিবোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং বেশ কিছু খুঁটিনাটির দিকে পরিচালকের দৃষ্টি। যেকারনে ভালো লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির বিখ্যাত একটি দৃশ্যের সুচারু ব্যাবহার। বুদ্ধদেব বসু, জয় গোস্বামী, সুবীর সেন, বই দিতে এসে রাফির উৎসুক দৃষ্টি, চেপে রাখা দুশ্চিন্তা, সেউঁতির মায়ের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে কবিতার বইয়ের পাতায় লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত ভালোবাসা, বাইকের পিছনে বদলে যাওয়া আরোহী, বব ডিলান, দোতলার ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে টুকরো টুকরো কথা অথবা মূহুর্তে মূহুর্তে বদলে যাওয়া অভিব্যক্তিগুলো মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রাত্যহিকতার ছোঁয়াচ লাগা ঘটনাগুলোও কখনো কখনো জন্ম দেয় মধ্যবিত্ত রূপকথার। তার জন্য প্রয়োজন হয়না কোন আরোপিত কৃত্রিমতার। অস্থির সময়ে স্বস্তি দেওয়া স্নিগ্ধ আলোয় ভরা এই গল্পের রেশ তাই ‘নায়ক’ সিনেমার বিখ্যাত ডায়ালোগের মত ‘মনে রেখে দেবো’।