সময়টা তখন ডিসেম্বর, ২০০৪। অকল্যান্ডে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল তখন নিউজিল্যান্ডের কাছে শোচনীয়ভাবে হারছে। অকল্যান্ড থেকে ১০ হাজার কিলোমিটারেরও দূরে, শ্রীলঙ্কার আম্বালাগোন্দায় নিজের বাড়িতে বসে টেলিভিশনে সেই খেলা দেখছে ১৫ বছর বয়সী এক বালক। জয় পরাজয় তখন তার কাছে মুখ্য নয়, সে গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং দেখছে। দেখতেই হত, ছেলেটা যে পরেরদিনই শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব ১৫ দলের ট্রায়ালে যোগ দেয়ার জন্য এরইমধ্যে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছে!
দিনটি ছিল পূর্ণিমা। রীতি অনুযায়ী পুরো বাড়ি পরিষ্কার করছিলেন দীনেশ চান্দিমালের মা। কিছুক্ষণ পরেই ভয়ার্ত গলায় মায়ের আর্তনাদ শুনতে পেলেন চান্দিমাল। চান্দিমাল প্রথমে ভেবেছিলেন মা হয়তো সাপ-খোপ জাতীয় কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন। সাপ নয়, চান্দিমালের মা অমন চিৎকার করেছিলেন সুনামির প্রলয়ঙ্করী রুপ দেখে।
আম্বালাগোন্দা ছিল সবচেয়ে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গ্রামগুলোর একটি। ১৫ ফুট উঁচু ঢেউগুলো তীব্র বেগে আছড়ে পরছিল উপকূলীয় অঞ্চলে। প্রথম ঢেউটা আঘাত হানার পর পানি আস্তে আস্তে সমুদ্রে ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু কে জানত, এরপরই আরও ভয়ংকর সব ঢেউ অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য! শত শত লোকের প্রানহানি হল, যারা কোনোমতে বেঁচে গেল তাদের ঘরবাড়ি সব বিধ্বস্ত। ভীত, ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর দু চোখ ভর্তি স্বপ্ন এক নিমেষে মিলিয়ে গেল সুনামির আঘাতে।
এরপরের অভিজ্ঞতা শুনুন চান্দিমালের নিজের মুখেই, ‘গ্রামের এক আঙ্কেল এসে আমাদের বললেন, সুনামি আঘাত হেনেছে, এক দৈত্য আঘাত হেনেছে! সবাইকে বললেন যার যার পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে। তারপর আমরা প্রাণপণে দৌড়ানো শুরু করলাম। ২০০-৩০০ মিটার দৌড়ানোর পর সৌভাগ্যক্রমে একটা পাহাড় পেয়ে গেলাম। ওই পাহাড়ে উঠে আমরা নিজ চোখে দেখলাম, কিভাবে আমাদের ঘর বাড়ি সব ফোমের মত মিলিয়ে গেল’!
ওইদিনের আগে সুনামি নামটা কখনো শোনেননি চান্দিমাল। কিন্তু ওইদিনের পরে একদিনের জন্যেও সুনামি শব্দটা ভুলতে পারেননি তিনি। এখনো ওইদিনের ভয়ার্ত স্মৃতি তার মনে তরতাজা, সুনামি নামটা নেয়ার সময় ভয়ে তার কণ্ঠ কাঁপে, যন্ত্রণা ফুটে ওঠে প্রতিটা শব্দে। চোখের পলকে নিজের ঘর, ট্রায়ালে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে রাখা কিট ব্যাগ, পরিবারের সহায় সম্বল সবকিছু সমুদ্রে তলিয়ে যেতে দেখেছেন।
সমুদ্রের প্রলয় নাচন শেষ হওয়ার পর চান্দিমাল ছুটে গিয়েছিলেন, তার কিট ব্যাগটা খোঁজার জন্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে ব্যাগটা খুঁজে পেয়েছিলেন বটে, তবে সম্পূর্ণ ভেজা ও পরিত্যক্ত অবস্থায়।
সেদিনের সেই স্মৃতি চান্দিমাল ও তার পরিবারের মনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল, সুনামির পর সমুদ্রের কাছে তারা মাত্র দুইবার গিয়েছেন! সমুদ্রের প্রাণঘাতী ও প্রলয়ঙ্করী রুপ দেখার পর আবার সেখানে ফিরে যাওয়ার সাহস করতে পারেননি তারা।
২৬ ডিসেম্বরের ওই দুঃসহ স্মৃতি চান্দিমালকে আরও সুসংহত করেছিল, মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করেছিল। তাদের কোন ঘর ছিল না, খাবার কেনার মত পয়সা ছিল না। পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনাই ছিল তখন তার একমাত্র লক্ষ্য। এবং নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে চান্দিমাল বেছে নিলেন নিজের প্রিয় ক্রিকেটকেই।
‘আমাদের তখন মাথা গোঁজার মত জায়গা ছিল না। আমাকে একজন ক্রিকেটার বানাতে, একজন অধিনায়ক বানাতে আমার পরিবার এবং আমি নিজে, অনেক কষ্ট করেছি। সুনামি আমাদের সব কেড়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনার পর আমি আরও বেশি করে একজন ক্রিকেটার হতে চেয়েছি, একজন ভালো ক্রিকেটার হতে চেয়েছি। ক্রিকেটকেই ধ্যান-জ্ঞান করে পরে থেকেছি আমি। ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করে নিতাম নিজের জন্য, আমাকে এখন এটা করতে হবে, তারপর ওইটা করতে হবে, এরকম’।
‘সুনামির পর এক-দুই মাস আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল, না ছিল ঘর, না ছিল খাবার, না ছিল কাপড়। তারপরেও আমি কখনো দুর্বল হইনি, ক্রিকেটার হওয়ার লক্ষ্য থেকেও সরে আসিনি। আমার মনে হয় ওই তাড়নাটাই আমাকে ভালো ক্রিকেটার হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছে’।
পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য সুযোগটা যখন এল, চান্দিমাল তাই কিছু না ভেবে লুফে নিলেন সেটা। ধর্মাশোকা কলেজের হয়ে সেরা পারফর্মার ছিলেন চান্দিমাল, ব্যাটিং ও কিপিং দুই দিকেই। বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই গ্লাভস হাতে দুর্দান্ত পারফর্মার চান্দিমাল। কখনো নাকি একটি ক্যাচও চান্দিমালের গ্লাভস ছেড়ে বের হত না!
আনন্দ কলেজের বিপক্ষে এক ম্যাচে চান্দিমালের কলেজ গুটিয়ে যায় ১২০ রানেই। সেই ১২০ এর মধ্যে চান্দিমালের একার অবদানই ছিল অপরাজিত ৭৭ রান! সেদিনের চান্দিমালের লড়াকু মনোভাব দেখে প্রতিপক্ষ দলের কোচ উদয়ানন্দ পেরেরা চান্দিমালের বাড়ি গিয়ে তাকে কলম্বো পাঠানোর কথাও বলে এসেছিলেন।
অথচ এই আনন্দ কলেজে নাকি আসতেই চাননি চান্দিমাল। পরিবারের ইচ্ছাতেই তার কলম্বো আসা। চান্দিমাল নিজেই বলেছেন সে কথা, ‘আমি যেতে চাইনি, আমার পরিবারই আমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে সেখানে। ধর্মাশোকা কলেজ আমার প্রথম স্কুল, এখানে খেলতে আমি ভালবাসতাম। আমার পরিবার আমাকে বুঝিয়েছিল, কলম্বোতে গেলে আমি অন্তত একটা ভালো চাকরি পাব। আমিও ভেবে দেখলাম, আমার যাওয়াই উচিত। ৬ মাস ধরে আমরা একটা সরকারি অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। কলম্বো এসে ক্রিকেট খেলে ভালো একটা চাকরি জোগাড় করাটাকেই তাই আমার যথার্থ মনে হয়েছিল’।
আনন্দ কলেজের দিনগুলো বেশ কষ্টেই কেটেছিল চান্দিমালের। পরিবার ছেড়ে এত দূরে একা থাকতে কষ্ট হত, খাবার নিয়েও সমস্যায় পরতেন। তারপরেও পরিবারের মানুষদের বুঝতে দেননি নিজের কষ্ট। সবসময় হাসি ধরে রাখতেন নিজের মুখে।
‘কলম্বোতে কাউকে চিনতাম না, আনন্দ হোস্টেলে ছিলাম প্রায় ৩-৪ বছর। হোস্টেলের খাবার বেশ বাজে ছিল। আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করত, থাকতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা, খাবার দাবার নিয়ে কষ্ট হচ্ছে কিনা। অনেক সময়ই কষ্ট হত, তাও তাদের জানতে দিতাম না। প্রায় সময়ই সকালের নাস্তা করতাম না, ভালো লাগত না ওখানকার খাবার। তারপরেও বলতাম, আমি ভালো আছি’।
তবে অন্ধকারের পাশে আলোও ছিল। কলেজে সদাচারী হিসেবে সুনাম ছিল চান্দিমালের, তার ভালো আচরণের জন্য সবাই পছন্দ করত চান্দিমালকে। চান্দিমাল যখন হোস্টেলে থাকতেন না, প্র্যাকটিসে থাকতেন, হোস্টেলের কর্মীরা তার জন্য খাবার বানিয়ে রাখতেন আলাদা করে। হোস্টেলে ফেরার পর সেই খাবার তার রুমে এনে দিয়েও যেতেন।
নিজের জীবনের এরকম চরাই উতরাইয়ের মত অধিনায়ক চান্দিমালকেও যেতে হয়েছে অনেক ভালো খারাপের মধ্য দিয়ে। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস দায়িত্ব ছাড়ার পর টেস্ট অধিনায়কের ব্যাটন দেয়া হয় চান্দিমালের হাতে। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই দেশের মাটিতে ভারতের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয় চান্দিমালের শ্রীলঙ্কা, তারপরেও দলের উপর থেকে আস্থা হারাননি তিনি।
নিজের স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থকেই সবসময় প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত চান্দিমাল, ‘২০১৩ সালটা আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। অধিনায়ক হিসেবে মোটামুটি পারফর্ম করলেও ব্যাট হাতে আমার পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছিল না। কারণ তখন আমি ৬ নম্বরে ব্যাট করতাম। টি-২০ তে ছয়ে নেমে আসলে ২-৩ ওভারের বেশি পাওয়া যায় না, বড় স্কোরের সুযোগও খুব বেশি পাওয়া যায় না। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের একজন হওয়ার সুযোগ ছিল আমার সামনে। কিন্তু আমি তা করতে চাইনি।
কারণ তখন কুশাল পেরেরা খুবই ভালো ব্যাটিং করছিল। আমি তাই ভাবলাম, দিলশানের সাথে কুশালই ওপেন করুক, এতে ডান-বাম কম্বিনেশনটাও বজায় থাকে। এরপরের পজিশনগুলোতে মাহেলা, সাঙ্গা ও অ্যাঞ্জেলো। আমি চেয়েছিলাম আমাদের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানেরা অন্তত ১০-১৫ ওভার খেলে আসুক। তারপর আমি নামতাম ছয়ে। আমি নিজের কথা ভাবিনি, দলের ভালোর কথাই ভেবেছিলাম’।
২০০৪ সালে সুনামির সাথে লড়ে নিজের বিধ্বস্ত পরিবারকে উদ্ধার করেছিলেন চান্দিমাল। ২০১৭ তে এসেও আবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি। এবার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট টিমকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ। চান্দিমাল প্রস্তুত এই পরীক্ষার জন্যও। জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে এসেছেন যিনি, তিনি আর কোন চ্যালেঞ্জ কেই বা ভয় পাবেন!
ক্রিকবাজ অবলম্বনে