নাসিরুদ্দিন হোজ্জা কাপড়ে রঙ করার দোকান খুললেন। ব্যবসা বেশ জমজমাট। একদিন শহরের খলিফা এলেন একটি কাপড় নিয়ে, রঙ করিয়ে স্ত্রীকে উপহার দেবেন সেটি। হোজ্জাকে নিয়ে প্রচলিত বেশ কিছু গল্প তার কানেও এসেছিল, কীভাবে সে সাধারণ মানুষকে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে শুনেছিলেন খলিফা। কাজেই একই সঙ্গে হোজ্জাকে একটা শিক্ষাও দেবেন বলে মন স্থির করেন তিনি।
হোজ্জাকে বললেন, পাকা রঙ হতে হবে। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ আর কালো বাদ দিয়ে রঙ করাবেন। পারবেন তো?
অবশ্যই, এ আর তেমন কি?
তাহলে কবে নিতে আসব?
শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো দিন নিয়ে যাবেন।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা- এই নামটির সাথে মিশে আছে এমন আরও অনেক মজার গল্প আর বেশ কিছু দ্বিধা। আদৌ এই নামে কোনো চরিত্র ছিল কিনা, থাকলেও কোন দেশে ছিল এসব নিয়ে সংশয়ের কোনো শেষ নেই, আর এই সংশয় দূর করারও কোনো উপায় নেই।পৃথিবীর অনেক দেশ তাকে সে দেশের সন্তান বলে দাবি করে, তাঁর জন্মোত্সব পালন করে, তাঁকে নিয়ে সাংবত্সরিক মেলা বসায়।
মধ্যযুগে আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে সেলজুক শাসনামলে ইরানের বৃহত্তর খোরাসানে তিনি বসবাস করতেন। অবশ্য নিকট ও মধ্য প্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশই নাসিরুদ্দিনকে তাদের দেশের বলে দাবী করে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক এবং উজবেকিস্তান। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তার নাম বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। সাধারণত অধিকাংশ সংস্কৃতিতে “হোজ্জা” এবং “মোল্লা” নামে পরিচিত। তিনি জনপ্রিয় দার্শনিক এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তার হাস্যরসাত্মক গল্প এবং উক্তিগুলোই তাকে বিখ্যাত করে রেখেছে। চীনে তিনি “আফান্টি” নামে পরিচিত এবং চীনারা তাকে উইগুরের তুর্কী ব্যক্তি বলে মনে করে।
মতান্তরে হোজ্জার দাবিদারদের মধ্যে সর্বাগ্রে আছে তুরস্ক। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে তুরস্কের আকসেহির প্রদেশে তাঁর জন্ম ১২৭৫ কিংবা ১২৮৫তে তাঁর মৃত্যু হয়। সেখানে তাঁর সমাধিও আছে। এই সমাধি ঘিরে প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ জুলাই আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন হোজ্জা উত্সব চলে।
হোজ্জাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন অধ্যাপক মিকাইল ব্যায়রাম। তিনি মনে করেন, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার জন্ম পশ্চিম আজারবাইজান খয় শহরে। তাঁর পুরো নাম নাসির উদ-দিন মাহমুদ আল-খোয়ি, বংশনাম আহি এভরান। তিনি পড়াশোনা করেছেন খোরাসান শহরে। হেরাতে বিখ্যাত কুরআনে মুফাসছির ফকর আল-দিন আল-রাজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর অধীনে পড়াশোনা করেন। মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করতে লোকবল সংগঠিত করার জন্য বাগদাদের খলিফা তাঁকে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় পাঠান।
তিনি ক্যায়সিরির কাজী নিযুক্ত হয়ে বিচারাসনে বসেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে মওলানা জালালুদ্দিন রুমির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। মসনবিতে তাঁর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। দ্বিতীয় কায়কাউসের দরবারে তাঁকে উজির নিয়োগ করা হয়।
মঙ্গোল আক্রমণের বিরোধিতা তাঁকে বিশেষ খ্যাতিমান করে তোলে। বহু শহরে বসবাস, বহু ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সঙ্গে চেনাজানা, তাঁর রসবোধ হোজ্জাকে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতি আপন করে নেয়। তুরস্ক থেকে আরব ভূখণ্ড, পারস্য থেকে আফগানিস্তান, রাশিয়া থেকে চীন— তিনি সর্বত্রই আদৃত হন।
নাসিরুদ্দিনের নামের সঙ্গে মোল্লা, খোজা, আফেন্দি, হোজ্জা অনেক কিছু যোগ হয়েছে। হোজ্জার রস-কাহিনী কিছু লিখিত হয়েছে, কিছু লোককথার মতো মুখে মুখে ছড়িয়েছে। হোজ্জার রস-রচনার প্রাচীনতম আবিষ্কৃত পাণ্ডুলিপিটি ১৫৭১ সালের।
বিচার ব্যবস্থা, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে অনেক ঠাট্টা-মশকরা করার পরও হোজ্জা মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কখনো পণ্ডিত, কখনো বোকা, কখনো খামখেয়ালি চরিত্র হিসেবে হোজ্জা ফার্সি, আরবি, উর্দু, আফগানি, আলবেনীয়, আর্মেনীয়, বাংলা, বসনীয়, বুলগেরীয়, গুজরাটি, হিন্দি, কুর্দিশ, রুশ ও চৈনিক সংস্কৃতির একান্ত আপনজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। দুষ্প্রাপ্য তুর্কি চিত্রকর্মে নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দার্শনিকী আত্মপ্রকাশ হিসেবে। ইউনেস্কো ১৯৯৬-৯৭কে আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন বর্ষ হিসেবে উদযাপন করেছে।
হোজ্জার অনেক গল্প আফ্রিকার সোয়াহিলি ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় আবু নওয়াসের গল্প হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রভাব ইউরোপেও পড়েছে। তাঁর গল্প ঈশপের গল্প হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— যেমন বাবা-ছেলে ও তাদের গাধার গল্পটি। মোল্লা নাসিরুদ্দিন নামের একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিন সারা পৃথিবীতে পরিচিত। মানুষের মুখে, গল্পের ছলে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন।