তিনি এভারেস্ট জয় করেছেন, বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন, একাধিক বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী চিফ স্কাউট হয়েছেন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। ডিসকভারি চ্যানেলের কল্যাণে সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া ‘অতিমানব’ বেয়ার গ্রেইলসের অনেক জানা অজানা কথা থাকছে আজকের প্রিয়লেখার আয়োজনে।
অ্যাডভেঞ্চার ও ভ্রমণের প্রতি আপনার প্যাশন শুরু হল কবে থেকে?
বেয়ার গ্রেইলস: ছোটবেলা থেকেই আমার বাবার সাথে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করতাম, টুকটাক উঠেছিও। তখন থেকেই আসলে অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আমার নেশা শুরু। নেশাটাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন স্কাউটেরা। আসলে জগৎকে জানার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা থাকলে আর সেটা করে দেখানোর তাগিদ থাকলে পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মানুষ পৌঁছাতে পারবে না। ঠিক এই কারণেই আমি ‘বেয়ার গ্রেইলস সারভাইভাল অ্যাকাডেমি’ খুলেছি, অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রয়োজনীয় স্কিলগুলোর বিকাশ যেন ঘটে, সেটা নিশ্চিত করাই অ্যাকাডেমির লক্ষ্য।
সারভাইভাল অ্যাকাডেমি স্থাপনের পিছনে আপনার অনুপ্রেরণা কি ছিল?
বেয়ার গ্রেইলস: টেলিভিশনের বাইরে গিয়েও আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম, এমন কিছু যা মানুষকে স্বাবলম্বী করবে। বছরের পর বছর ধরে লোকেরা আমাকে একই প্রশ্ন করে চলেছে, ‘আমরা কিভাবে ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড, বর্ন সারভাইভার এসব অনুষ্ঠানে আসতে পারি’? কিন্তু সবাইকে নিয়ে তো আমরা আসলে শ্যুটিং করতে পারব না। আমরা অনুষ্ঠানগুলোর সেলিব্রিটি ভার্শন করেছি, ‘গেট আউট অ্যালাইভ’ অনুষ্ঠানে আমরা সাধারণ মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছি। অ্যাকাডেমীর পেছনে প্রচুর শ্রম যাবে, অর্থও যাবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, অনেক ঘুরতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা চাই মানুষেরা যেন টিকে থাকার দক্ষতাটা অর্জন করতে পারে।
অ্যাকাডেমীর জন্য আপনারা স্কটিশ হাইল্যান্ডকেই কেন বেছে নিলেন?
বেয়ার গ্রেইলস: টিকে থাকার দক্ষতা অর্জনের জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হয়েছে আমাদের। এখানে সারা বছর জুড়ে আপনি একইসাথে বাতাস, বৃষ্টি, ঠাণ্ডা সবই পাবেন। মিলিটারিতে একটা কথা শেখানো হয়, ‘ট্রেইন হার্ড, ফাইট ইজি’। অন্য কোথাও অ্যাকাডেমিটা করলে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার এই কৌশলগুলো রপ্ত করতে অসুবিধা হত নতুনদের।
এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত কোনটা?
বেয়ার গ্রেইলস: তরুণ বয়সেই ’21 SAS’ (ব্রিটিশ আর্মির স্পেশাল এয়ার সার্ভিস) এ পাস করাটা আমার জন্য খুব বড় একটা বিষয় ছিল। এটি আমাকে নতুন করে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে, যা আমার আগে কখনো ছিল না। শো’তে আমি যেই সারভাইভাল স্কিলগুলো দেখাই তার অনেক কিছুই আমি এখান থেকে শিখেছি। ১২০ জন ছিলাম আমরা শুরুতে, শেষ পর্যন্ত মাত্র চারজন আমরা কোর্সটা শেষ করতে পেরেছিলাম।
বেস্টসেলার লিস্টে নাম্বার ওয়ান হওয়া, কিংবা এভারেস্টে ওঠা, সবকিছু নিয়েই আমি সুপার প্রাউড। কিন্তু সত্যি বলতে, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব আমার তিন ছেলে ও তাদের সাথে একত্রে জীবন কাটানো।
স্টিফেন ফ্রাই, উইল ফেরেল, জোনাথন রসদের মত অনেক সেলিব্রিটিকে আপনি আপনার শো’তে নিয়ে গিয়েছেন। বাস্তব জীবনের এই কঠিন দিকটার সাথে তারা কিভাবে খাপ খাইয়েছেন?
বেয়ার গ্রেইলস: আমি কিছু অবিশ্বাস্য লোকেদের আমার সাথে অ্যাডভেঞ্চারে নিয়েছি, এবং আমি সবসময় এটা মনে রেখেছি, সেলিব্রিটি হলেও সকল চাকচিক্যের আড়ালে তারা আমার আপনার মতই মানুষ। আউটডোরের এই স্বাধীনতাটা তারা উপভোগ করেছে, তাদের গণ্ডিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
আপনার খাওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিচ্ছিরি খাবার কি?
বেয়ার গ্রেইলস: ছাগলের কাঁচা অণ্ডকোষ খাওয়াটা বাজে ব্যাপার ছিল। মুখে দেয়ার পরে আমি সাথে সাথে থু করে ফেলে দিয়েছিলাম! ছাগলের কাঁচা অণ্ডকোষ খাওয়া, ওয়াক থু! চমরী গাইয়ের হিমায়িত অক্ষিগোলক খাওয়াটাও একইরকম বাজে ছিল। কিন্তু সারভাইভালে তো এসব করতেই হবে!
অবসরে আপনি কোথায় যেতে পছন্দ করেন? ফাইভ স্টার হোটেলের আতিথেয়তা নেয়া হয়েছে কখনো?
বেয়ার গ্রেইলস: ওয়েলস কোস্টের ছোট্ট দ্বীপে সময় কাটাতে পছন্দ করি আমি। এখানেই আমি আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাই। ফাইভ স্টার হোটেলের কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের ফোর সীজনস হোটেলের কথা বলতেই হবে। আমার স্ত্রী সারাকে হোটেল থেকে টেনে বের করাও মুশকিল হয়ে পরেছিল!
‘দ্য আইল্যান্ড উইথ বেয়ার গ্রেইলস’ অনুষ্ঠানটির কথা কিছু বলুন। শো’টি করার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণা কি ছিল?
বেয়ার গ্রেইলস: আপনার কাছ থেকে বিছানা, গরম পানি, কম্বল সবকিছু নিয়ে নেওয়া হল, তারপরেও টিকে থাকার মত সাহস, দক্ষতা ও মনোবল আপনার আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্যই মূলত ‘দ্য আইল্যান্ড উইথ বেয়ার গ্রেইলস’। এই শো’তে আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মানুষ কি এখনো প্রাকৃতিক শিকারি আছে, নাকি নাগরিক সভ্যতার কাছে বশ স্বীকার করেছে, সেটা দেখাই মূল উদ্দেশ্য।
বেয়ার গ্রেইলসের ডিকশনারিতে ‘ভয়’ বলে কোন শব্দ কি আদৌ আছে?
বেয়ার গ্রেইলস: অবশ্যই আছে! সত্যি বলতে গেলে অনেক আছে। আমিও তো মানুষ, অন্যান্য মানুষের মতই ভয় পাই আমি। সারভাইভাল মানে আপনি একেবারে ভয়শূন্য হয়ে যাবেন, তা না। সারভাইভাল হল সিদ্ধান্ত নেয়া, সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক এগিয়ে যাওয়া ও সেটা করে দেখানো। আমি আমার বাচ্চাদের মুখ আরেকবার দেখতে চাই, এই তাড়নাই আমাকে সারভাইভালের পথে টিকিয়ে রাখে। স্কাইডাইভিং আমার কাছে অনেক কঠিন লাগে। মিলিটারিতে থাকার সময় এই স্কাইডাইভিং করতে গিয়ে আমার মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলাম। ১৮ মাস ধরে সেই দুঃস্মৃতি আমাকে তাড়া করেছে। তবুও শো এর প্রয়োজনে আমাকে প্রচুর স্কাইডাইভিং করতে হয়।
আপনি যে এতসব ঝুঁকি নেন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো চাপ অনুভব করেন না?
বেয়ার গ্রেইলস: নাহ, তেমন কোন চাপ আসলে আমি অনুভব করি না। আমরা যখন প্রথম ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ করেছিলাম, পরিচালক আমাদের বলেছিলেন, ‘এই শো এর কেবল একটি সিজন ই হবে’। জানিনা কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, হয়তো কারোর কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিংবা লোকেরা একঘেঁয়ে হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে। আমি রাজিও হয়েছিলাম, কিন্তু সৌভাগ্যবশত মানুষ একঘেঁয়ে হয়নি, কারোর তেমন কোন দুর্ঘটনাও ঘটেনি।
কাজ ও পরিবার দুটোকেই একসাথে সামলান কিভাবে?
বেয়ার গ্রেইলস: এই কাজটা আসলে সবসময়ই কঠিন। আপনি প্রচুর ধনী, অনেক খ্যাতি আপনার, কিন্তু আপনার স্ত্রী আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিল, এটা আসলে কখনোই কাম্য নয়। সবসময় যে আমি সফল হই তা না, কিন্তু আমার স্ত্রী খুবই চমৎকার একজন মানুষ। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার তিনটা ছেলেও আছে, তাদেরও সময় দিতে হয়। যখন তারা স্কুলে থাকে, আমি তখন বাসায়। আবার তারা যখন বাসায়, আমি তখন কাজে। তাই যখনই আমি অবসর পাই, আমি আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাই।
পরিবারকে কখনো নিজের সাথে নিয়ে যান?
বেয়ার গ্রেইলস: নাহ। দুয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব ভয়াবহ। জঙ্গলের মাঝে একটা লজে তাদের রেখে আমি বন্দুক নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম। পাঁচদিন পর যখন আমি ফিরলাম, তারা সবাই জ্বরে আক্রান্ত ও মশার কামড়ে বিপর্যস্ত ছিল!
বাবার পেশা সম্পর্কে আপনার ছেলেদের মতামত কি?
বেয়ার গ্রেইলস: তারা তাদের বাবার পেশাটাকে পছন্দ করে। শো থেকে ফিরে যখন আমি এক কাপ চা নিয়ে বসি, তারা তখন তাদের জমানো পিঁপড়া নিয়ে আসে তাদের বাবাকে দেখানোর জন্য! ছেলেগুলোও অনেকটা আমার মতই হয়েছে। একদিন আমার ছোট ছেলেটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক ঘণ্টা ধরে আমরা সব জায়গায় খুঁজেছি। তারপর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সে ৫০ ফুট উঁচু এক গাছ বেয়ে নেমে আসছে! ওরা আসলে এরকমই।
Telegraph.co.uk এবং Kuoni.co.uk অবলম্বনে লেখা।