মিরপুর টেস্ট যেন ছিল সাকিব আল হাসানের জন্য স্বপ্নের এক টেস্ট। ম্যাচের চার ইনিংসের মধ্যে তিন ইনিংসেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ স্কোরার, দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে ৫ উইকেট, আবার চতুর্থ ইনিংসেও বল হাতে ৫ উইকেট। একজন অলরাউন্ডার এক ম্যাচ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কমই চাইতে পারেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে কিছু রান করতে পারলে এই টেস্টে অল্প যেটুকু অপূর্ণতা আছে সাকিবের সেটুকুও থাকত না।
অন্যদের চেয়ে অলরাউন্ডাররা এই একটা সুবিধা বেশি পেয়ে থাকেন, ব্যাটে বলে দুইভাবেই সমান অবদান রাখার সুযোগ পান। কিন্তু একই টেস্টের ৪ ইনিংসে একজন খেলোয়াড় ব্যাটে বলে পারফর্ম করেছেন, এমনটা কদাচিৎই ঘটে। তিন ইনিংসে বীরদর্পে পারফর্ম করাটাও তাই বিশেষ কিছুই বটে। সাকিব আল হাসানও বিশেষ কিছুই করে দেখিয়েছেন এই মিরপুর টেস্টে।
সাকিবের হয়ে কথা বলবে পরিসংখ্যানই। টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ১৪ তম বারের মত একই টেস্টে পঞ্চাশ ও দুই ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সাকিব। সময়সীমাটা যদি গত ২০ বছরে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে এমন নজির পাওয়া যাবে তিনবার, তার মধ্যে সাকিব একাই করেছেন দুবার। মিরপুর টেস্টের আগে করেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে। সাকিব ছাড়া এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আর কেবল ডেল স্টেইন, ২০০৮ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সাকিব ছাড়া এই কৃতিত্ব দুবার করে দেখানোর রেকর্ড আছে কেবল স্যার রিচার্ড হ্যাডলির।
আরেকটি অর্জনের দিকেও অনন্য সাকিব। একই টেস্টে দুইটি ফিফটি ও দুইবার পাঁচ উইকেট পাওয়ার বিরল কৃতিত্ব ক্রিকেট ইতিহাসেই দেখিয়েছেন মাত্র দুইজন। একজন ইয়ান বোথাম, আরেকজন সাকিব আল হাসান। ইয়ান বোথাম করেছিলেন ১৯৮১ হেডিংলি টেস্টে, আর সাকিব করেছেন ২০১১ মিরপুর টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
জ্যাক ক্যালিসের পর ক্রিকেট বিশ্ব জেনুইন অলরাউন্ডার খুব বেশি দেখেনি। যাদের দেখেছে, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান সব প্যারামিটারেই যোজন যোজন এগিয়ে। ২০১৪ সাল থেকে মাত্র পাঁচজন অলরাউন্ডার ১০০০ টেস্ট রান ও ৫০ টেস্ট উইকেটের ‘ডাবল’ অর্জন করতে পেরেছেন। একজন তো অবশ্যই সাকিব, বাকি চারজন ভারতের অশ্বিন, জাদেজা ও ইংল্যান্ডের স্টোকস, মঈন আলী।
পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে কম টেস্ট খেলেছেন সাকিব, তবুও সবার মধ্যে ব্যাটিং গড়ে সাকিব ঢের এগিয়ে। এই পাঁচ বছরে দলের মোট রানের প্রায় ১৬ শতাংশ করেছেন সাকিব, বাকি পাঁচজনের চেয়ে যা বেশি। দলের নেয়া মোট উইকেটের প্রায় ৩০ শতাংশ নিয়েছেন সাকিব, তার চেয়ে বেশি নিয়েছেন কেবল অশ্বিন। একজন অলরাউন্ডারের কার্যকারিতা মাপা হয় তাঁর ব্যাটিং ও বোলিং এভারেজের গড়ের পার্থক্য দিয়ে। যার পার্থক্য যত বেশি, তাঁর কার্যকারিতা তত বেশি ধরা হয়। এই পাঁচজনের মধ্যে সাকিবের গড়ের পার্থক্যই সবচেয়ে বেশি, দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাদেজার চেয়ে যা প্রায় দ্বিগুণ বেশি। সাকিবের ব্যাটিং গড় ৪৮.৭৬, বোলিং গড় ৩১.২৬, পার্থক্য ১৭.৫০। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাদেজার ব্যাটিং গড় ৩৩.২৫, বোলিং গড় ২৪.৩২, পার্থক্য ৮.৯৩। সাকিবের সাথে বাকিদের পার্থক্যটা এখানেই পরিষ্কার।
এই চারজনের মধ্যে সাকিবের সাথে সত্যিই যদি কারোর তুলনা করা যেতে পারে, তাহলে তিনি বেন স্টোকস। অশ্বিন আর জাদেজা মূলত বোলিং অলরাউন্ডার, মঈন আলীও তাই। স্টোকস সাকিবের মতই মিডল অর্ডারে ব্যাট করেন বলে সাকিবের সাথে তাঁর তুলনাটাই বেশি মানানসই। সেই স্টোকসকেও কিন্তু স্পষ্টতই পেছনে ফেলেছেন সাকিব। এই পাঁচ বছরে দলের মোট রানের ১৫.৭% করেছেন সাকিব, স্টোকস করেছেন ১১.৮%। আবার দলের মোট উইকেটের ২৯.৮% নিয়েছেন সাকিব, স্টোকস নিয়েছেন ১৩.৯%।
এই সময়সীমার মধ্যে ৩৫ টেস্ট খেলে ৮২ উইকেট নিয়েছেন স্টোকস, অর্থাৎ ম্যাচপ্রতি ২.৩ উইকেট। সাকিব ১৮ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৭৩ উইকেট, ম্যাচপ্রতি ৪.১ উইকেট। ব্যাটিং ও বোলিং পারসেন্টেজ যোগ করলে সাকিবের দাঁড়াচ্ছে ৪৫.৫% (ব্যাটিংয়ে ১৫.৭%, বোলিংয়ে ২৯.৮%)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অশ্বিনের ৪১.২%, জাদেজার ৩৪.৫%।
অন্তত ৫০ টেস্ট খেলেছেন, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে ১৪ জন ৩০০০ রান ও ১৫০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়েছেন। এই ১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনের ব্যাটিং-বোলিংয়ের গড়ের পার্থক্য সাকিবের চেয়ে বেশি- স্যার গ্যারি সোবার্স, জ্যাক ক্যালিস, ইমরান খান ও শন পোলক। এই তালিকায় সাকিব পেছনে ফেলেছেন ইয়ান বোথাম, রিচার্ড হ্যাডলি, ক্রিস কেয়ার্নস, কপিল দেবের মত অলরাউন্ডারদের।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বেশি খেলেছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে যারা সাকিবের অর্জনকে খাটো করতে চান, তাদের যুক্তিও কিন্তু ধোপে টিকছে না আসলে। ৫০ টেস্টের মধ্যে মাত্র সাকিব মাত্র ৬ টি টেস্ট খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এই ৬ টেস্টে ব্যাট হাতে তাঁর এভারেজ ৩৯.৫০, বল হাতে ২৩.২৬। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই ৬ টেস্ট হিসাবের বাইরে রাখুন, তাও সাকিবের পরিসংখ্যান হীরের মতই জ্বলজ্বল করবে। বাকি ৪৪ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং এভারেজ ৪১.২৫, বোলিং এভারেজ ৩৩.৫২।
এতসব পরিসংখ্যানের পরে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের গ্রেটনেস উপেক্ষা করার বোধহয় আর কোন সুযোগ নেই!
ক্রিকইনফো অবলম্বনে