কিছু মানুষ হয়তো কখনোই সাকিব আল হাসানকে ’৮০র দশকের সেই বিখ্যাত অলরাউন্ডার চতুষ্টয়ের সাথে তুলনা করতে রাজি হবেন না। তাদের প্রথম অভিযোগ, সাকিব পেস বোলিং করেন না। দ্বিতীয় অভিযোগ, সাকিব জিম্বাবুয়ে ও খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অনেক বেশি ম্যাচ খেলেছেন। এবং তৃতীয় অভিযোগ, বাংলাদেশের হয়ে খেলেন বলে যখনই তিনি কোন বড় দলের সাথে পারফর্ম করেন, তার রেটিং পয়েন্ট অন্যদের তুলনায় বেশি বাড়ে, যার প্রভাব পরে অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ে।
এমন না যে সাকিব সবাইকে জোর করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মানতে বাধ্য করছেন। কিন্তু দিনকে দিন পরিসংখ্যান ও অর্জনের তালিকা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরপর আর অবহেলা করারও বোধহয় সুযোগ নেই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০ রানের ঐতিহাসিক জয়ে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন, প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে ও তামিম ইকবালের সাথে ১৫৫ রানের জুটি গড়ে দলকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করেছেন। বল হাতে দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট নিয়েছেন।
সাকিবের আগে এক টেস্টে ফিফটি ও ১০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব একাধিকবার দেখিয়েছেন কেবল একজন, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ বোলার হিসেবে টেস্ট খেলুড়ে নয়টি দেশের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট লাভের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সবচেয়ে কম টেস্ট খেলে ৩০০০ রান ও ১৫০ উইকেটের মালিক হয়েছেন। তিন বছর আগে ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ব্যাটিং এভারেজের চেয়ে বোলিং এভারেজ কম, এমন এক দুর্লভ গ্রুপের সদস্যও সাকিব।
হয়তো এখনি জ্যাক ক্যালিস কিংবা বিখ্যাত অলরাউন্ডার চতুষ্টয়ের সাথে তুলনা করাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। কিন্তু অন্তত গত ১০ বছরে সাকিব আল হাসানের চেয়ে কোন খেলোয়াড় তাঁর দলের জন্য এককভাবে বেশি অবদান রেখেছেন, এমনটা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাঁর সেরাদের সেরা হতে চাওয়ার মানসিকতা ও নিজের খেলায় আরও উন্নতি আনতে চাওয়ার চেষ্টাই তাঁকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। একটা সময় ছিল যখন তাঁকে পুরো বোলিং ইউনিটের দায়িত্ব একা নিতে হয়েছে, আবার মিডল অর্ডার যেন ভেঙ্গে না পরে সেটাও খেয়াল রাখতে হয়েছে। কয়েকজন ভরসাযোগ্য ব্যাটসম্যান ও নতুন বোলিং সেনসেশনের আবির্ভাব হওয়ায় অনেকে ভেবেছিলেন সাকিবের এতটা অবদান না হলেও দল ঠিকই উতরে যাবে। ধারণাটা যে ভুল তা আর না বলে দিলেও চলছে।
সাকিব অবশ্য এতকিছু নিয়ে মাথা ঘামাতেই রাজি নন। দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরেই তিনি খুশি। জয়ের পরে তাই বলছিলেন, ‘ব্যাট ও বলে আমি সমানভাবে অবদান রাখতে চাই। দলের একজন সিনিয়র খেলোয়াড় হয়ে দলে অবদান রাখাটা আমার দায়িত্ব। দলের জয়ে অবদান রাখতে পারাটাই সেরা অনুভূতি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমরা খুবই কম খেলি, এই জয়টা তাই আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে’।
এই বছর টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি, দুটিই সাকিব। এই বছরই ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, শ্রীলঙ্কায় ম্যাচজয়ী সেঞ্চুরি করেছেন। কলম্বোয় ওই একই টেস্টেই চার উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কার রানটাকে সীমার মধ্যে বেঁধে রেখেছিলেন।
এর মাঝে খারাপ সময় যে আসেনি তাও না। বেশ কয়েকবার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট ছুঁড়ে ফেলে এসেছেন, মেহেদী হাসানের ছায়ায় ঢাকাও পরেছিলেন কিছুটা। হায়দ্রাবাদে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ২৪ ওভার বল করে ছিলেন উইকেটশুন্য। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই ১০ উইকেট তাই বোলার সাকিবকে বাড়তি আত্মবিশ্বাসই দেবে।
ব্যাটসম্যান হিসেবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বড় স্কোর করার সুযোগ খুব একটা পাননি, তারপরেও ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেছেন ঠিকই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটিই যেমন কথা বলবে সাকিবের হয়ে। টেস্টে ৫ নম্বরে ব্যাট করেন বলে ওয়ানডের চেয়ে অনেক স্বাধীনভাবে খেলতে পারেন।
তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরণের কারণে মাঝে মাঝে সমালোচনার মুখে পরতে হয় তাঁকে। ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই যেমন বাজে শট খেলে আউট হয়েছেন। কিন্তু সাকিব নিজে মনে করেন তাঁর সতীর্থদেরও আক্রমণাত্মক ভাবেই ব্যাট করা উচিত, “আগ্রাসনটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি আপনারা আমার দ্বিতীয় ইনিংসের আউট নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। এগুলো আসলে ‘ট্রিকি কন্ডিশন’। আমি চাই সকলের ভেতর এই সাহসটা থাকুক। পজিটিভ থাকলে কিন্তু তা বেশিরভাগ সময়েই দলের হয়ে কাজে দেয়”।
সাকিবের এই আত্মবিশ্বাসের ছটা ছড়িয়ে পরতে শুরু করেছে তাঁর সতীর্থদের মাঝেও। তারাও এখন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সাকিবের পারফরম্যান্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তারা, তাঁর পারফরম্যান্সের লেভেলের সাথে নিজেদের লেভেল মেলানোর চেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত। একই সাথে নিজেকেও আরও উঁচুতে তুলছেন সাকিব। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বোলিংয়ে আরও ফোকাসড হয়েছেন, নিজের ব্যাটিংয়েও আরও ধার বাড়িয়েছেন।
বাংলাদেশের খেলাকে আরও উন্নত করা, ও দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে উন্নতির ধারা বজায় রাখা, সাথে ব্যক্তিগত রেকর্ড ও পরিসংখ্যান- সবকিছু মিলিয়ে এবার বোধহয় সময় এসেই গেছে সাকিবকে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বলার, কিংবদন্তি বলার!
ক্রিকইনফো থেকে অনূদিত