আর কদিন বাদেই ঈদ। জমে উঠছে কোরবানির পশুর হাটগুলো। পুরান ঢাকার বিশেষ আকর্ষণ মিরকাদিমের গরুও চলে এসেছে বাজারে। বরাবরই এই গরুগুলো নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে হুলস্থূল পড়ে গেলেও এ বছর তুলনামূলক ভাবে ক্রেতারা যেন উচ্চ দামের ভয়ে একটু পিছিয়ে গেছেন। বাজারের হালহকিকত সম্পর্কে জানার আগে চলুন তবে জেনে আসা যাক মিরকাদিমের গরু কেন এতো নাম করা সেই বিষয়টি।
ঢাকার অদূরবর্তী একটি স্থান মিরকাদিম।ব্রিটিশ সময় থেকে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম ছিল বিখ্যাত একটি নদীবন্দরের নাম। সূদুর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে জাহাজ নোঙর করতো। তখন মিরকাদিমের এই বন্দরে লাখ লাখ মানুষের আনাগোনা ছিল, দিনরাত জাহাজের ভেঁপু বাজতো। কোলাহলমুখর থাকতো মিরকাদিম বন্দর। তৎকালীনএইবন্দরকে কেন্দ্র করে নানা রকম ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হতে থাকে বন্দরটি। তারই ধারাবাহিকতায় তেলের মিল, ধান চালের আড়তসহ শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
কালের বিবর্তনে মিরকাদিম সেই জৌলুস হারালেও এখন সেই বন্দরের স্মৃতি খুঁজে বেড়ায় মানুষ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই রাজসিক একটি ভাব আছে এখানকার মানুষের মধ্যে। তারা এখন কোনো না ঐতিহ্য লালন করে চলেছে ইতিহাসের পরম্পরায়। তেলের মিল, বহু চালের মিল ছাড়াও এখানে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের পুরনো ঐতিহ্যটাকে মনে করিয়ে দেয়।
এখানকার গরুর চাহিদা ইতিমধ্যে সারা বাংলায় ছড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে সাদা ধবল গরু আর ভুটানের বুট্টি গরুর জন্য মিরকাদিম সারা বাংলায় বিখ্যাত। এছাড়া ভারতের উড়িষ্যা, জঙ্গলি, নেপালের নেপালি গরুও এখানে লালন পালন হয়ে থাকে। ধান-চাল আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মিরকাদিমের ভূষি, কুড়া, খৈলসহ বিভিন্ন উন্নতমানের গরুখাদ্য খুব সহজে পাওয়া যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা মিরকাদিমের গরুকে মিনিকেট চালের খুদ, ভালো মানের খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুষি, গমের ভুষি, বুটের ভুষি খাওয়ান। এছাড়া প্রতিটি খামারেই গরু পালনে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগ করা হয়।
এখানকার খানদানি লোকেরা লোকজন দিয়ে কোরবানীর জন্য এসব উন্নত জাতের গরু লালন পালন করে থাকেন। তবে এসব গরুর সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ গনিমিয়ার হাটে। যুগ যুগ ধরে এই হাটে মিরকাদিমের বিখ্যাত সব গরু পাওয়া যায়, যা অনেক দামে কিনে নেয় পুরান ঢাকার খানদানি লোকেরা। এছাড়াও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকেও সুস্বাদু এই গরু কিনতে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে আবার আগেভাগে মিরকাদিমে এসে ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা দিয়ে যায়। পরে ঈদের আগে তাদের গরু বুঝে নেন। কয়েকমাস ধরে লালন পালন করে গরুর মালিককে বুঝিয়ে দেওয়ার রীতিটি বহু আগে থেকেই চালু রয়েছে।
তবে গরুর এই ব্যবসাটিতে এখানকার ব্যবসায়ীরা উৎসাহপাচ্ছেনা।ভুষি, কুড়া আর খৈলের দাম বৃদ্ধি আর অপ্রতুল হওয়ায় তারা হতাশ। তাছাড়া এর বাইরের জিনিস তারা গরুকে খাওয়ান না। এসব গরুর মাংস সুস্বাদু হওয়ার এটাই প্রধান কারণ। মশারি টানিয়ে গরুকে ঘুম পাড়ানো, সার্বক্ষণিকভাবে তাদের তদারকি করা, এক কথায় গরু ব্যবসায়ীরা তাদের সন্তানের মতো করে বিভিন্ন জাতের গরু লালন পালন করেন। আর এ কারণেই মিরকাদিমের এই গরুর ব্যাপক চাহিদা দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। কোরবানির ঈদে পুরনো ঢাকাবাসীর রসনা বিলাসে আর কিছু থাকুক বা নাই থাকুক, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল (সাদা) গরুর মাংস থাকা চাই।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সবেমাত্র এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে (গনিমিয়ার হাট পুরনো নাম) মীরকাদিমের সাদা গরুর হাট বসে। মীরকাদিমের গরুর কদর ও দাম একটু বেশি। ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা গরুর মূল্য হয়ে থাকে। তবে মীরকাদিমের গরু মুন্সীগঞ্জের কোনো হাটে বিক্রি হয় না।
গরু খামার মালিক বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘মীরকাদিমে গরু বানানো এখন প্রায় বন্ধ। সামনের বছর নাও পেতে পারেন। আগের বছর ৫০টা গরু বানাইছিলাম, এবার ২২টা। সাদা বুট্টি গরু এখন পাওয়া যায় না, আগের বছর লোকসান খাইছি।’
তিনি বলেন, ‘মীরকাদিমের গরুর একটা ঐতিহ্য ছিল। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা পঙ্গু হইয়া যাইতাছি। ঢাকা থেকে কসম কাইটা আইছি আর গরু পালুম না। দুই-তিন মাস পরে মন মানাইতে পারিনা। ঢাকার হাটে এক ঘণ্টার বেচাকেনা। আমরা গরু নামাই যার ভাগ্য ভালো সে দাম ভালো পায়।’
গরুকে খাওয়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভূষি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি খাওয়াই।’
স্থানীয় খামার মালিক সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে আসা গরু কিনে এনে লালন করে থাকেন তারা। ছোট বুট্টি গরু ১০-২০ হাজার টাকায় কিনে এনে ৪-৫ মাস লালন করে ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। এই গরু বেশি বড় হয় না। দেখতে গোল গাল। আর নেপালি ও ভারতের অন্য প্রজাতির বড় গরু কেনা হয় প্রায় লাখ টাকা আর ছয় মাস লালন পালন করে বিক্রয় হয় ২ থেকে ৬ লাখ টাকা। প্রতি গরুর পিছনে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি।
খামার শ্রমিকরা জানান মীরকাদিমের ধবল গরু বানাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। নিজের বাচ্চার মতো লালন করেন তাদের। নতুন গামছা দিয়ে গোসল করানো হয় গরুগুলোকে। সব সময় চোখে চোখে রাখেন তাদের। প্রতিটি গরু বড় করতে ও কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য উপযোগী করে তুলতে ৪-৬ মাস সময় লাগে।
তাছাড়া এই গরুগুলোকে বড় করতে ইনজেকশন বা গরু মোটাতাজার কোনো ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। সাদা গরু এখন পাওয়া যায় না তাই বিভিন্ন রংয়ের গরু বানানো হয়। খামারের ভেতরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বাইরের কাউকে খামারের ভেতর ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না।এ বছর প্রায় ২০ হাজার গরু নিয়ে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে ব্যবসায়ীরা হাজির হলেও আশানুরূপ ক্রেতাদের ভিড় না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন মিরকাদিমের খামার মালিকরা।