বাংলা চলচ্চিত্রের এক মহীরুহ ছিলেন তিনি। তাঁর অভিনয় দক্ষতা ও বাংলা সিনেমায় তাঁর অবদানের কথা মাথায় রেখে বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাঁকে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই খেতাব তাঁর চিরসঙ্গী। প্রায় তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করা নায়করাজ রাজ্জাক জীবনে অসংখ্য পুরষ্কার পেয়েছেন। সেসবের মধ্যে আলাদা হয়ে থাকবে ৫ বার জাতীয় পুরষ্কার পাওয়ার গৌরব। যেই ৫ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন নায়করাজ, এক নজরে দেখে নিন সেগুলোই।
কি যে করি:
‘কি যে করি’ সিনেমার মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মত সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক। জহিরুল হক পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, ববিতা, দারাশিকো, সুলতানা সহ আরও অনেকে।
বড়লোকের একমাত্র নাতনী শাহানা চৌধুরী (ববিতা)। বিয়ে করতে একদমই অনাগ্রহী শাহানা, কিন্তু দাদুর বিশাল সম্পত্তির মালিক হতে গেলে বিয়ে করতেই হবে তাকে। কারণ উইল অনুযায়ী দাদুর মৃত্যুর পর সব বিষয় সম্পত্তির মালিক হবে শাহানা ও তার স্বামী। সম্পত্তি পাওয়ার জন্য তাই দারুণ এক ফন্দি আঁটে শাহানা, বিয়ে করে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বাদশাহকে (রাজ্জাক)। পরিকল্পনা খুব সহজ, স্বামীর মৃত্যুর পর সব সম্পত্তির মালিক হবে শাহানা একা। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদশাহ মুক্তি পেয়ে গেলে স্বামীর দাবি নিয়ে সে আসে শাহানার কাছে। সিনেমায় দারুণ অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরষ্কার জিতেছিলেন রাজ্জাক। সিনেমায় রাজ্জাকের সঙ্গী ববিতাও সেবার সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরষ্কার জিতেছিলেন, তবে এই সিনেমার জন্য নয়, নয়নমণি সিনেমার জন্য।
অশিক্ষিত:
রাজ্জাক দ্বিতীয়বার জাতীয় পুরষ্কার জেতেন দুই বছর পর ১৯৭৮ সালে, অশিক্ষিত সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার কাহিনী ও আজিজুর রহমানের পরিচালনায় নির্মিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক, অঞ্জনা, এটিএম শামসুজ্জামান, রোজি এবং আরও অনেকে।
গ্রামের এক চৌকিদার রহমত (রাজ্জাক) পড়ালেখা জানে না। রহমতকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নেয় গ্রামেরই ছেলে মানিক (সুমন)। মানিকের কাছেই সই করা শেখে রহমত। দুর্নীতিবাজ আড়তদারের দুর্নীতি দেখে ফেলায় খুন করা হয় মানিককে। মানিকের খুনের সাক্ষী হয় রহমত, এবং রহমতের সইয়েই শাস্তি হয় খুনীদের। সিনেমাটি মূলত একটি সামাজিক বার্তাসম্পন্ন সিনেমা। সিনেমার ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইসে’ ও ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত’ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
বড় ভালো লোক ছিল:
৩য় বার জাতীয় পুরষ্কার পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয় রাজ্জাককে। চার বছরের অপেক্ষা ঘোচে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত রাজ্জাক গ্রাম্য পীরের ছেলে। পীর সাহেব এক ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা গেলে রাজ্জাক গ্রামে ফেরত আসে, উদ্দেশ্য পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া। আশ্রয় নেয় বাবার বন্ধুর বাড়িতে। বাবার বন্ধুর মেয়ে অঞ্জু ঘোষের সাথে রাজ্জাকের ভালো সম্পর্ক, আবার রাজ্জাক যাকে খুঁজছে সেই ট্রাক চালক প্রবীর মিত্রের সাথে অঞ্জুর প্রেমের সম্পর্ক।
হঠাৎ একদিন রাজ্জাক তার ভেতর এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অস্তিত্ব টের পায়। সহজে নানা সমস্যার সমাধান করে ফেলে। এতে করে এক ধরণের অহংকার চলে আসে তার ভেতর, সাথে অঞ্জুর প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে পরে সে। এর ফলে রাজ্জাকের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা চলে যায়। তখন তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়া। এভাবেই এগিয়েছে সিনেমার কাহিনী। অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া সিনেমার ‘হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুশ’ গানটি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
চন্দ্রনাথ:
চতুর্থবারের মত রাজ্জাক জাতীয় পুরষ্কার জেতেন ১৯৮৪ সালে, চন্দ্রনাথ সিনেমায় অভিনয়ের কারণে। শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চাষি নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এই সিনেমায় রাজ্জাকের বিপরীতে অভিনয় করেন দোয়েল। এছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন সুচন্দা, গোলাম মুস্তাফা সহ আরও অনেকে।
উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণ চন্দ্রনাথ পিতার মৃত্যুর পর কাশীতে গেলে সেখানে তার দেখা হয় সরযূর সাথে। সরযূকে পছন্দ করে বিয়ে করে চন্দ্রনাথ। সরযূর মা সুলোচনার নিম্নবর্ণের কথা জানতে পেরে গর্ভবতী স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায় চন্দ্রনাথ। কিন্তু ছেলে হওয়ার পর চন্দ্রনাথ আবার তার স্ত্রীকে ফেরত আনে।
যোগাযোগ:
রাজ্জাক শেষবারের মত জাতীয় পুরষ্কার জেতেন ১৯৮৮ সালে যোগাযোগ সিনেমার জন্য। মইনুল হোসেন পরিচালিত সিনেমায় রাজ্জাক ছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন চম্পা, শবনম, জাফর ইকবাল, প্রবীর মিত্র, রাজীব।
সাহেদ চৌধুরী (রাজ্জাক) একজন চা-বাগানের কর্মকর্তা। জুলেখাকে (শবনম) প্রথমবার দেখে পছন্দ হওয়ায় তার বাবার কাছে তাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। জুলেখার বাবা তার প্রস্তাবে সম্মত হন এবং তাদের বিয়ে দেন। সাহেদ ও জুলেখার সংসারে কেয়া নামে এক কন্যা সন্তান আসে। সাহেদ সারাদিন বাড়ি আর বাগানে একগেঁয়ে সময় কাটায় দেখে স্ত্রী জুলেখা তাকে ক্লাব-পার্টিতে যেতে বলে। একদিন সাহেদ জুলেখাকে নিয়ে ক্লাবে যায়। সেখানে ক্লাবের সদস্যদের সাথে মিশতে না পারায় সাহেদ জুলেখাকে গেঁয়ো-অশিক্ষিত বলে অপমান করে। এই ঘটনার ফলে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সাহেদ বাড়িতে মদ খেয়ে মাতলামি করে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে জুলেখা তার কন্যা কেয়াকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি চলে যায়। এরপর ঘটনা মোড় নেয় অন্য দিকে।