পটকা মাছের নাম কে না শুনেছেন? গ্রামে গঞ্জে হামেশাই চোখে পরে এই পটকা মাছ। এই পটকা মাছেরই আত্মীয় বংশীয় মাছ ফুগু, সুস্বাদের আড়ালে যার দেহে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর বিষ!
বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফুগু বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম পাফার ফিশ। এই ফুগুর যকৃত, চোখ ও নাড়িভুঁড়ি তে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর বিষ- টেট্রোডোটক্সিন বা টিটিএক্স। পটাশিয়াম সায়ানাইডের চেয়েও হাজার গুণ বেশি বিষাক্ত এই টেট্রোডোটক্সিন! এই টিটিএক্স থাকার কারণেই ফুগুকে বলা হয় সবচেয়ে বিষাক্ত মাছ।
ফুগু একটি জাপানি শব্দ, যার স্থানীয় অর্থ ‘নদীর শুকর’। মাছেদের মধ্যে তো বটেই, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যেই দ্বিতীয় বিষাক্ত প্রাণী মানা হয় ফুগুকে। ফুগুর বিষ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা হবে আপনার, যখন জানবেন, একটি ফুগুর বিষ দিয়ে প্রায় ত্রিশ জন সুস্থ মানুষের প্রাণনাশ করা সম্ভব! মানুষ মারার এই অসম্ভব ক্ষমতার কারণে জাপানের কানসাই এলাকার মানুষ এই মাছের নাম দিয়েছে ‘টেপ্পো’, স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ পিস্তল বা বন্দুক।
ফুগুর শরীরে বিদ্যমান টিটিএক্স মানুষের কোষ পর্দার সোডিয়াম চ্যানেল বন্ধ করে দেয়, সাথে স্নায়ুতন্ত্রেও ব্লকেজের সৃষ্টি করে। এতে করে মস্তিষ্কের সাথে বাকি দেহের যোগাযোগ থেমে যায়। আস্তে আস্তে দেহ অবশ হতে শুরু করে, সময়ের সাথে সাথে যা প্যারালাইসিসে রুপ নেয়। আর ডায়াফ্রাম কাজ না করায় মানুষের শ্বাসতন্ত্র অকেজো হয়ে পরে, ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে।
ফুগুর শরীরে বিষের পরিমাণ সবচাইতে বেশি থাকে এর যকৃতে। এছাড়া হৃদপিণ্ড থেকে শুরু করে চোখ, নাড়িভুঁড়িতেও প্রচুর পরিমাণে বিষ থাকে। এই ফুগু নিয়ে আরও গবেষণার জন্য জাপানে স্থাপিত হয়েছে ‘ফুগু রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। সেই ইনস্টিটিউটের গবেষণা মোতাবেক, ফুগু খেয়ে যেসব মানুষ আক্রান্ত হয় তাদের অর্ধেকই যকৃতের বিষ দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফুগুর বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ধরা হয় টোরাফুগু প্রজাতির মাছকে।
অন্যান্য সেক্টরের মত এই ফুগু মাছের ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে জাপানিরা। ফুগুকে বিষমুক্ত করার নিজস্ব কায়দা উদ্ভাবন করে নিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, জাপানের নামীদামী রেস্তোরাঁগুলোতে ফুগু খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। নিজস্ব বিশেষ পদ্ধতিতে ফুগুকে বিষমুক্ত করে থাকে জাপানিরা। প্রথমে ফুগুর বিষাক্ত অংশগুলো একটি বিশেষ পলিথিনে ভরে সেগুলোকে বেঁধে লকারে রাখা হয়। এভাবে সারাদিনে জমা হওয়া বিষাক্ত অংশগুলো একত্রে পাঠানো হয় চুল্লীতে। সেখানে বিষাক্ত অংশগুলোকে উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
তবে বিষমুক্ত করতে শিখেছে বলেই যে তার যত্রতত্র ব্যবহার করে তারা, সেটাও কিন্তু না। জাপানে খোলা স্থানে প্রকাশ্যে ফুগু বিক্রি নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত বাবুর্চিরাই রেস্তোরাঁয় ফুগু মাছ দিয়ে রান্না করে থাকেন। ফুগু রান্নার জন্য কঠিন সব পরীক্ষা দিয়ে আগে লাইসেন্স নিয়ে হয় জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। পরীক্ষা নেয়া হয় দুইদিন ব্যাপী। প্রথম দিন হয় লিখিত, সেটা পাস করার পর দ্বিতীয় দিনে হয় আসল পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে দেয়া হয় একটি ফুগু মাছ, ছুরি আর ট্রে। নির্ধারিত বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে ফুগু কাটাকুটি করে এর বিষাক্ত অংশ আলাদা ট্রেতে রাখতে হয়। যারা সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে কাজটা শেষ করতে পারেন, তাদের সেই ফুগু দিয়ে একটি আকর্ষণীয় পদ তৈরি করতে হয়। এবং পরীক্ষার সর্বশেষ ধাপ হিসেবে সেই রান্না করা খাবার নিজেকে খেয়ে দেখতে হয়!
এই কঠিন পরীক্ষা ব্যবস্থা সত্ত্বেও জাপানে ফুগু-শেফদের কদর নেহায়েত কম নয়। প্রতি বছরই প্রায় ৮০০-৯০০ পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। যারা সম্পূর্ণ কাজ নির্ভুলভাবে করে থাকেন, কেবল তারাই সার্টিফিকেট পান। যে কারণে ক্রেতারাও শেফদের উপর যথেষ্ট আস্থা রাখার সাহস করতে পারেন।
তবে তারপরেও যে জাপানে ফুগু খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটে না তা না। প্রতি বছরই ফুগু খেয়ে কমবেশি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়, তবে সেগুলোর বেশিরভাগই জেলেদের অসতর্কতার কারণে হয়ে থাকে। আপনি যদি হয়ে থাকেন ভোজনবিলাসী, হাতে থাকে পয়সা, আর হয়ে থাকেন রোমাঞ্চপ্রিয়, তাহলে জাপান গেলে একবার চেখে দেখে আসতে পারেন ফুগু মাছ!