বন্ধুবান্ধবরা মিলে ঢাকার মধ্যে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে লিস্টের একদম উপরের দিকে থাকবে পুরান ঢাকার নাম। গোটা এলাকাটাকেই যেন বলা যায় ঐতিহ্যের ঢাকা। আহসান মঞ্জিল, বাহাদুর শাহ পার্ক, বলধা গার্ডেন, জিরজিরা প্রাসাদ, লালবাগ কেল্লা প্রতিটি স্থাপনার সাথে মিশে আছে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস। ঐতিহাসিক এই নিদর্শনগুলোর তুলনায় পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংকে এখন হয়তো কিছুটা ফিকেই মনে হতে পারে। তবুও এই বোর্ডিংটির ইতিহাসের সাথে মিশে আছে আলাদা একটি আবেদন, আজ নাহয় ঘুরে আসা যাক বিউটি বোর্ডিং থেকে।
কবি-সাহিত্যিকদের কাছে পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং এক আড্ডার কেন্দ্রস্থল। বাংলাবাজারে বইয়ের মার্কেট পেরিয়ে শ্রীশচন্দ্র দাস লেনে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি জমিদার বাড়ি। এটির কোল ঘেঁষেই দোতলা একটি বাড়ি। ছোট লোহার গেট পেরোলেই ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখানে দুর্বা ঘাসে মোড়ানো ফাঁকা জায়গা- আড্ডাস্থল। পাশেই অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা। হলদে-কালচে রঙের বাড়িটির এক কোনায় লেখা রয়েছে “বিউটি বোর্ডিং”।
১৯৪৯ সালের শেষের দিকে প্রহ্লাদ সাহা ও তার ভাই নলিনী মোহন সাহা তৎকালীন জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছ থেকে ১১ কাঠা জমি নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন এই বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে। তখনকার সাহিত্য আড্ডার জন্য মুসলিম সুহৃদ সম্মিলনী, নবাববাড়ি, ঢাকা প্রকাশের কার্যালয়সহ অনেক জায়গা থাকলেও সবার পছন্দের জায়গা ছিল এই বিউটি বোর্ডিং। বাংলা সাহিত্যের অনেক দিকপালের পদচারণে এই বোর্ডিং ধন্য হয়েছে। সেসব ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন।
শুরু থেকেই এখানে আড্ডা দিয়েছেন এ দেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক, চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিংবদন্তিরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসিমউদ্দীন। এসেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সনে পাক হানাদার বাহিনী বিউটি বোর্ডিং এর মালিক প্রলহাদ চন্দ্র সাহা সহ আরো ১৬ জনকে ধরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। প্রহলাদ বাবুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার চলে যায় কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হবার পর কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুর ডাকে প্রহ্লাদ বাবুর পরিবার দেশে ফিরে এসে আবার হাল ধরেন বিউটি বোর্ডিং এর।
বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান মালিক তারক সাহা। প্রাচীন এই জমিদারবাড়িটিকে সযত্নে প্রতিপালন করছেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় জামিদার পরিবারটি ভারতে চলে যায়। তখন এখানে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। সে সময় এখান থেকেই প্রকাশিত হত সোনার বাংলা নামের একটি পত্রিকা। দেশভাগের পর বাংলাবাজার হয়ে ওঠে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তখন থেকেই বিউটি বোর্ডিং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায়। একসময় সোনার বাংলা পত্রিকাটির অফিস কলকাতায় চলে গেলে এর মালিক সুধীরচন্দ্র দাসের কাছ থেকে জায়গাটা বুঝে নেন প্রহ্লাদচন্দ্র সাহা ও তার ভাই নলিনীকান্ত সাহা। তারপর সোনার বাংলা প্রেসের জায়গায় শুরু হয় আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা।
চল্লিশের দশকে এই আড্ডা পুরান ঢাকায় সুখ্যাতি লাভ করে। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন। আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লেখেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশের পাণ্ডুলিপি। সমর দাস বহু গানের সুর তৈরি করেছেন এখানে বসে। শামসুর রাহমান লিখেছেন- মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলা বাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিং-এ পরষ্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন। খাবারঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। হঠাৎ করেই শিহরণ জাগবে এই ভেবে একসময় যে ঘরে খেয়ে গেছেন বহু গুণী মানুষ, আজ সেখানে আপনিও বসেছেন পেট পূজাতে। তবে শিহরণ হারিয়ে যাবে সরষে ইলিশের ঘ্রাণে। জিহবায় পানি চলে আসবে মুহূর্তেই। পুরান ঢাকায় কম দামে পেট ভরা খাবার খেতে চাইলে বিউটি বোর্ডিং এর কোন বিকল্প নেই।