তাঁকে বর্ণনা করতে আলাদা কোন বিশেষণের প্রয়োজন নেই। তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের সেরা ফুটবলার, ফুটবল সম্রাট, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফুটবল বিশ্ব শাসন করা, ৩ বারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে জনপ্রিয় ফুটবল সাইট ফোর ফোর টু এর সাথে কথা বলেছেন নিজের অনেক কিছু নিয়েই।
আপনার সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ…
পেলে: এটা বলা কঠিন। আমি যাদের বিপক্ষেই খেলি, সবসময় সেরা ডিফেন্ডারকে আমাকে মার্ক করার জন্যই রাখা হত। তারপরেও যাদের বিপক্ষে খেলেছি, তাঁদের মধ্যে ববি মুর এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারই সেরা। বেকেনবাওয়ার ছিল দুর্দান্ত, খুবই বুদ্ধিমান ফুটবলার। তাঁকে হারানো ছিল খুবই কঠিন। আর আমার দেখা সেরা সেন্টার ব্যাক ছিল মুর। মাথার কাজ সে খুবই দ্রুত করত।
আপনার ১০০০ তম গোল প্রসঙ্গে…
পেলে: আমি অনেক ভালো ভালো গোল করেছি। হেডে অনেক গোল করেছি, বাইসাইকেল কিকে করেছি, ড্রিবল করেও করেছি। সে কারণে মানুষ সবসময়ই জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘এত ভালো গোল করেছেন আপনি, আপনার হাজারতম গোলটা পেনাল্টি থেকে এল কেন’?
এরপর ব্রাজিলের এক বিখ্যাত সাংবাদিক লিখলেন, ‘ঈশ্বর চাইছিলেন ওই মুহূর্তটাতে পুরো বিশ্ব থেমে যাক, এবং গোলটা দেখুক। সে কারণেই গোলটা পেনাল্টি থেকে হয়েছিল’। আমিও এটা বলতেই পছন্দ করি, এটা ঈশ্বরেরই সিদ্ধান্ত ছিল। আমি যে গোলটা মারাকানায় করব, এটাও ঈশ্বরই ঠিক করে রেখেছিলেন।
অনেকেই বলেন, হাজারতম গোলটা মারাকানায় করব বলে আমি এর আগের ম্যাচটা গোলকিপার হিসেবে খেলেছিলাম। আসলে কিন্তু এমন কিছু ছিলনা, ব্যাপারটা পুরোপুরি কাকতালীয় ছিল। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আমি রিজার্ভ গোলকিপার হিসেবে খেলতাম, ব্রাজিল জাতীয় দল এবং সান্তোস উভয় জায়গাতেই। কারণ কি ছিল জানেন? ইনজুরি কিংবা লাল কার্ড না হলে একজন গোলকিপারকে রিপ্লেস করা অত সহজ ছিল না!
তখন এমন একজন আউটফিল্ড প্লেয়ারকে বাছাই করা হত, যে কিনা গোলকিপার হিসেবেও খেলতে পারবে। সে কারণে আমি গোলকিপিংয়ের অনুশীলনও করতাম, এবং ভালই করতাম। যে ম্যাচে আমি হাজারতম গোল করলাম, তার আগের ম্যাচে আমরা ব্রাজিলের উত্তরাংশে একটা ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম। আমাদের গোলকিপার হঠাৎই ইনজুরিতে পরে, সে কারণে গোলবারের নিচে আমি দাঁড়াই।
কিন্তু লোকে বলতে শুরু করল, মারাকানায় হাজারতম গোল করব বলে আমি ইচ্ছা করে আগের ম্যাচটা গোলকিপার হিসেবে খেলেছি। কিন্তু আমার মাথায় এমন কোন চিন্তা ছিল না। যেখানেই খেলি, আমি শুধু গোলটা করতে চেয়েছি। আমার একটা গোল প্রয়োজন ছিল, সেটা মারাকানায় হল না অন্য কোথাও হল, সেটা দেখা আমার জন্য জরুরি ছিল না!
যে মুহূর্তটির কথা মানুষ আপনাকে সবচেয়ে বেশি মনে করায়
পেলে: আজ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আমি যেখানেই যাই, লোকে আমাকে ১৯৭০ বিশ্বকাপে গর্ডন ব্যাঙ্কস আমার যে হেডটি ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেটির কথা বলে।
আমি বিশ্বকাপে অনেক গোল করেছি, কিন্তু তাও লোকে ওই হেড এবং সেইভটার কথাই মনে রেখেছে! তাদের কাছে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি বলতেই থাকি, আমি তো অনেক গোল করেছি, তাও কেন এই সেইভটার কথাই তোমরা মনে করাও! তারা এটার কথাই বলে, কারণ খেলাটা এত সুন্দর ছিল! জেয়ারজিনহোর ড্রিবল, ক্রস, আমার হেড, এবং অবশ্যই ওই সেইভ- সবকিছুই সুন্দর ছিল।
ইতালির বিপক্ষে আমি সুন্দর একটা হেডে গোল করেছিলাম, কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাঙ্কস ফিরিয়ে দিল। আমি এটা কখনোই ভুলব না, কারণ কেউ আমাকে ভুলতেই দিবে না!
আপনার সম্পর্কে প্রচলিত সবচেয়ে বড় মিথ…
পেলে: আমি নাকি বাইসাইকেল কিকের আবিষ্কর্তা। ব্রাজিলে আমার অনেক আগেই লিওনিডাস প্রথম বাইসাইকেল কিক নিয়েছিল। ছোট অবস্থায় এটা আমি অনুশীলন করতাম, সে কারণে আমি বাইসাইকেল কিকে ভালো ছিলাম। ব্রাজিলে অনেক শিশুই ছোট অবস্থায় এটা অনুশীলন করে।
আপনার সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়াড়
পেলে: ক্যারিয়ারে এতসব গ্রেট প্লেয়ারের সংস্পর্শে এসেছি, এভাবে একজনের নাম নেয়াটা আসলে সম্ভব না। কিছু সেরা ফুটবলার তো কখনো বিশ্বকাপ খেলারই সুযোগ পাননি। আলফ্রেডো ডি স্টেফানোই যেমন, এমন অসাধারণ ফুটবলার, কিন্তু বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। এছাড়া ক্রুইফ, পুসকাস, জিকো, বব চার্লটন, জর্জ বেস্ট… আরও অনেকেই আছেন পছন্দের তালিকায়।
আপনার সেরা মুহূর্ত…
পেলে: ঈশ্বর আমাকে এমন তিনটি মুহূর্ত দিয়েছেন। আমি সবসময় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিদায় বলতে চেয়েছিলাম, এবং আমি সৌভাগ্যবান, সেটা আমি করতে পেরেছিলাম। ১৯৭০ এ যখন আমি কামব্যাক করলাম, আমি জানতাম এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। সান্তোসেও একই রকম অবস্থা ছিল। সান্তোসে আমার শেষ বছর, ১৯৭৪ এ, ওরা লিগ জিতল, আমি হলাম সর্বোচ্চ গোলদাতা। এরপর আমি নিউইয়র্কে গেলাম, আমি জানতাম ’৭৭ মৌসুমই হবে আমার শেষ মৌসুম। ঈশ্বরকে আমি বললাম, আমি এখান থেকে চ্যাম্পিয়ন না হয়ে বিদায় নিতে পারিনা! এবার আমাদের জিততেই হবে। শেষ পর্যন্ত জিতেই মাঠ ছেড়েছিলাম আমরা।
সাক্ষাৎকার ও ছবি কৃতজ্ঞতা- ফোর ফোর টু ডট কম