ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমারের দলবদল নিয়ে সম্প্রতি যেন এক তুলকালাম কান্ডই ঘটে গেল। কত মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নেইমারকে কেনা হল, কত বছরের জন্য নেইমার নতুন দলে গেলেন, সেখানে তাঁর সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কেমন, সবই এদেশের তরুণ ফুটবল ভক্তদের নখদর্পণে। রাত জেগে ইউরোপিয়ান লিগের খেলা দেখা তো একপ্রকার অভ্যাসই হয়ে গেছে আমাদের তরুণদের।
না, বাইরের ফুটবল দেখা, খোঁজ খবর রাখার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু নিজের দেশের ফুটবলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা জানাও তো আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে! দেশের ফুটবলে এখন চলছে ঘোর দুঃসময়। উঠে আসছে না নতুন কোন প্রতিভা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাফল্যের কোন দেখা নেই। এই খারাপ সময়ে দেশের ফুটবলকে উজ্জীবিত করতে, সমর্থকদের মধ্যে ফুটবলের হারানো সেই উন্মাদনা ফিরিয়ে আনতে, বিশেষ করে তরুণদের দেশের ফুটবল, দেশীয় সুপারস্টারদের সম্পর্কে জানাতেই প্রিয়লেখার এই বিশেষ আয়োজন। আর সেই শুরুর জন্য মোনেম মুন্নার চেয়ে উপযুক্ত আর কেই বা হতে পারেন!
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজ সাকিব আল হাসান, মাশরাফি মর্তুজারা একেকজন ক্রেজ। অসংখ্য ক্ষুদে খেলোয়াড়ের অনুপ্রেরণা তাঁরা। কিন্তু বছর বিশেক আগেও দৃশ্যপটে ছিলনা ক্রিকেট, তখন ছিল শুধুই ফুটবলের জয়জয়কার। আর সেসময়কার সবচেয়ে বড় ক্রেজ ছিলেন প্রয়াত ফুটবলার মোনেম মুন্না, বাংলাদেশের তো বটেই, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে মানা হত যাকে।
এক কথায় বাংলাদেশের ফুটবলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন মুন্না। দেশে কিংবা দেশের বাইরে, বাংলাদেশের ফুটবলেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন তারকা এই ডিফেন্ডার। ‘কিং ব্যাক’ এই দুটি শব্দই যথেষ্ট ছিল মুন্নাকে বোঝানোর জন্য।
১৯৬৮ সালে নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেয়া মুন্নার ঢাকায় খেলা শুরু ১৯৮১ সালে, পাইওনিয়ার ডিভিশনের দল গুলশান ক্লাবের হয়ে। পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগরে। মুন্নার প্রথম লাইমলাইটে আসাও ওই ’৮২ সালেই। তখনকার বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের একটি প্রদর্শনী ম্যাচ ছিল। ওই ম্যাচে ১৪ বছরের মুন্না এমনই নজরকাড়া পারফরম্যান্স করেন, বাফুফের কর্মকর্তারা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন, এই ছেলে ১৪ বছর বয়সেই জাতীয় দলে খেলার যোগ্য!
সেই যে আলোয় আসা, এরপর আর কখনো অন্ধকারে যেতে হয়নি মুন্নাকে। নিজেকে ছাপিয়েছেন, ছাপিয়ে গেছেন সমসাময়িক সবাইকেই। পরের বছরেই যোগ দিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে, দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দলকে প্রথম বিভাগে তুলে আনলেন মুন্না।
১৯৮৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে পদার্পণ মোনেম মুন্নার। সিউলে হতে যাওয়া এশিয়ান গেমসের দলে প্রথমবারের মত ডাক পান মুন্না। অভিষেকের পর থেকেই একরকম অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেন জাতীয় দলের। মুন্নাকে ছাড়া জাতীয় দল কল্পনা করা ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার! খেলা ছাড়ার আগ পর্যন্ত দাপটের সাথে লাল সবুজ পতাকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে আবাহনীতে যোগ দেন সে সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্রেজ। এরপর আবাহনী আর মোনেম মুন্না হয়ে উঠেন একে অপরের সমার্থক, ১৯৯৭ সালে অবসরের আগ পর্যন্ত খেলেছেন আকাশি নীলদের হয়ে। মুন্নার আবাহনীতে যোগদানটাও ছিল অসম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ, তখনকার সময়ে জাতীয় রেকর্ড ২০ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন আবাহনীর সাথে! এখনকার গড়পড়তা ফুটবলারদের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ আহামরি কিছু মনে না হলেও সেই সময়ে ২০ লাখ টাকায় একজন ফুটবলার চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন, এ কথা কল্পনাও করা যেত না। মুন্নার বদৌলতে অকল্পনীয় সেই ঘটনারই সাক্ষী হয় ঢাকার ফুটবল। মোনেম মুন্না যে তখন আকাশচুম্বী এক ক্রেজের নাম!
মাঠের মুন্না ছিলেন প্রায় নির্ভুল এক ফুটবলার। ঢাকার ফুটবলে স্ট্রাইকারদের জন্য রীতিমত এক বিভীষিকা ছিলেন মুন্না। তাঁকে কাটিয়ে গোল দেয়া যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্যই ছিল অসম্ভব চ্যালেঞ্জের এক কাজ। নিজের সামর্থ্যের উপর অগাধ আস্থা ছিল তাঁর। মারাত্মক ট্যাকল করতে পারতেন তিনি, খুব ভালো ফ্রি কিক ও মারতে পারতেন। হেডেও ছিলেন দারুণ শক্তিশালী। অল্প সময়েই নিজের প্রতিভা ও পারফরম্যান্স দেখিয়ে দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন মুন্না।
শুধু দেশের সমর্থকেরাই নন, মুন্নায় মুগ্ধ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দর্শক সমর্থকেরাও। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ফুটবলারই কলকাতায় খেলেছেন, কিন্তু তাদের কেউই মুন্নার মত এত জনপ্রিয়তা, এত ভালবাসা, এত সম্মান পাননি। শুধু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ফুটবলার কেন, ইস্টবেঙ্গলের কোন বিদেশি ফুটবলারই মুন্নার সমপর্যায়ের কিংবদন্তি হতে পারেননি। ১৯৯১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ তিন মৌসুম মুন্না খেলেছেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলে। আর ওই তিন মৌসুমেই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ক্লাবটি। তবে শুধু শিরোপা জেতার কারণে নয়, মুন্নার খেলোয়াড়ি দক্ষতাই বেশি করে নজর কেড়েছিল দর্শকদের। ইস্টবেঙ্গল ও তাদের অন্যতম সেরা বিদেশি এই ফুটবলারটিকে সম্মানিত করেছে তাদের ‘হল অফ ফেম’ এ মুন্নাকে জায়গা করে দিয়ে। আজও মুন্নার অবদান বিনম্র চিত্তে স্মরণ করে কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরা।
জাতীয় দলকেও সাফল্যের ভেলায় ভাসিয়েছেন অধিনায়ক মুন্না। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় মুন্নার হাত ধরেই, ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় মুন্নার নেতৃত্বে। সেই বছরই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মুন্নার নেতৃত্বেই শিরোপার খুব কাছে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
খেলা ছাড়ার পরেও আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন প্রাণের ক্লাব আবাহনীর সাথে। ম্যানেজার হিসেবে আবাহনীকে জিতিয়েছেন ফেডারেশন কাপ সহ বেশ কিছু শিরোপা। দেশের ফুটবলকে আরও অনেক কিছুই দেয়ার ছিল অসম্ভব প্রতিভাবান এই মানুষটির, কিন্তু কিডনিজনিত সমস্যায় ভুগে মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিংবদন্তি মুন্না। মানুষটি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর ছাপ রয়ে গেছে এদেশের ফুটবল অঙ্গনে। এখনো বিদেশে বাংলাদেশের ফুটবলের প্রসঙ্গ উঠলে সামনে চলে আসে মোনেম মুন্নার নাম। বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ অটো ফিস্টার তো মুন্নাকে প্রশংসায় ভাসাতে গিয়ে একবার বলেই দিয়েছিলেন, মুন্না ভুল করে এদেশে জন্মেছিলেন!
শুধু ফুটবল মাঠে না, মোনেম মুন্নার কদর ছিল বিজ্ঞাপন অঙ্গনেও। মুন্নার বিপুল জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে ১৯৯৬ সালে মুন্নাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়েছিল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ইউনিলিভার।
মোনেম মুন্নাকে শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মোনেম মুন্না সেতু’, রোজ সেতু দিয়ে পারাপার করলেও যা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। দেশের মৃতপ্রায় ফুটবলে আবারো অক্সিজেন যোগাতে এই কিংবদন্তি ফুটবলারদের কীর্তিগাঁথা ক্যারিয়ারের কথা এদেশের তরুণ ফুটবলারদের মনে আবারো গেঁথে দেয়ার দায়িত্বটা নিতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকেই। তাঁদের দেখানো পথেই যে হাঁটতে হবে এদেশের ফুটবলকে!