আমাদের দেশে একটি প্রবাদ বেশ প্রচলিত রয়েছে। তা হচ্ছে, শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়া। এর মানে বোঝাচ্ছে, স্বেচ্ছায় আপনি আপনার শত্রুর কাছে মূল্যবান কিছু রাখতে দিচ্ছেন। আমাদের আজকের আলোচনায় আমরা বাস্তবিক কোন শেয়ালের কাছে যাচ্ছি না বরং তার চাইতেও বিপদজনক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
একটি অ্যাপ। এই অ্যাপের সাহায্যে আপনি কাউকে ইচ্ছেমত বার্তা পাঠাতে পারবেন তবে আপনার পরিচয় থাকবে গোপন। অর্থাৎ, আপনি যাকে বার্তা পাঠাচ্ছেন, সে আপনার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছেন না। আপনার পরিচয় থেকে যাচ্ছে অগোচরে। ঠিক এই অ্যাপটিই গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের ওয়ালে কিংবা টাইমলাইনে এই অ্যাপটির কথা শেয়ার করছে এবং মানুষকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাদের সম্পর্কে কিছু জানানোর জন্য। অ্যাপটির নাম “সারাহাহ”। আজ এই ধরণের এনোনিমাস অ্যাপের কিছু ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হবে আপনাদের কাছে। তবে এটি ঠিক যে, এই এনোনিমাস অ্যাপটি বিশ্বে প্রথম নয়। এর আগেও ইক ইয়াক, সিক্রেট, আফটার স্কুল? নামক অ্যাপগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এই সবগুলো অ্যাপেই প্রেরণকারী তার নামধাম গোপন করে কোন তথ্য প্রেরণ করতে পারতেন বা ইচ্ছেমত কোন ধরণের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর এবং গুগল প্লে স্টোরে সারাহাহ বেশ রকেটের মত গতিতেই ব্যবহারকারীদের কাছে যাত্রা করছে। কেউ কেউ বলছেন অচিরেই এটি বেশ বড় ধরণের একটি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম হতে যাচ্ছে। আবা দ্বিমত পোষণকারীদের সংখ্যাও কম নয়। তারা বলছেন, এমন ধরণের একটি প্ল্যাটফর্মের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করা আদৌ বুদ্ধিমানের মত কোন কাজ হবে কিনা। আবার সারাহাহ কিন্তু পরিচয়ও প্রকাশ করার কথা বলেছে ব্যবহারকারীদের।
সৌদি বংশদ্ভূত জেইন আল-আবিদিন তাওফিক নামক এক প্রোগ্রামার এই এনোনিমাস অনলাইন মেসেজিং প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছেন। আরবি ভাষায় “সারাহাহ” মানে হচ্ছে স্পষ্টতা, সততা, নির্ভীক প্রকাশ ইত্যাদি। মজার ব্যাপার দেখুন, এই অ্যাপের নামের অর্থের সাথে কিন্তু তার কাজের কোন মিল নেই। যদিও এর নাম নির্ভীক প্রকাশ, আপনি কিন্তু আপনার বার্তাটি পাঠাচ্ছেন পরিচয় গোপন করেই। তাহলে নির্ভীক প্রকাশ কেমন করে ঘটছে এখানে? পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে না কি?
তিউনিশিয়া, ঈজিপ্ট, সৌদি আরবে এর ব্যবহারকারী হচ্ছে যথাক্রমে ২.৫, ১.৭, ১.২ মিলিয়ন। এর বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে তাওফিক গত জুন মাসের শেষের দিকে অ্যাপটি ইংরেজী ভাষায়ও ডেভেলপ করেন। এরপর থেকেই কিছু বিপত্তি ঘটে।
এভারি হার্টম্যান্স নাম্নী এক ব্লগার বিজনেস ইনসাইডার-এ লিখেছেন, “সারাহাহ অ্যাপটি হচ্ছে নামধাম গোপন করে কাউকে বুলি(হয়রানি) করবার জন্য পারফেক্ট একটি মাধ্যম। কেউ যদি স্বেছায় বুলি বা হয়রানির স্বীকার হতে না চান, তাহলে আমি তাদের বলব এই অ্যাপটি ব্যবহার না করবার জন্য।”
এর কিছু কারণও রয়েছে। যদিও এই অ্যাপটি ডেভেলপ করা হয়েছে সহকর্মী কিংবা শুভানুধ্যায়ীদের নিকট হতে ‘অনেস্ট অপিনিয়ন” বা যথাযথ যৌক্তিক মন্তব্য পাওয়ার জন্য, এই অ্যাপের বদৌলতে রীতিমত হেট স্পিচ এবং রেসিজম প্রচার করছে তরুণ তরুণীরা। এছাড়াও নানা ধরণের অশ্লীল ও আপত্তিকর বার্তা তো রয়েছেই।
অ্যাপ স্টোরের রিভিউ সেকশনে গিয়ে এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এভারি তার ব্লগে এই সম্পর্কে বলেছেন। একজন ব্যবহারকারী জানান,
“আমার ছেলে এই অ্যাপ ব্যবহার করবার জন্য একটি একাউন্ট খোলে এবং ২৪ ঘন্টার মাঝেই একটি ভয়াবহ বর্ণবাদী মন্ত্যবের শিকার হয়। এই সাইট ঘৃণা ছড়াবার জন্য আদর্শ একটি অ্যাপ।”
দ্বিতীয় একজন ব্যবহারকারী বলেন, “আমি আপনাকে এই অ্যাপ ব্যবহার না করবার পরামর্শ দেব, যদি আপনি স্বেচ্ছায় নিজেকে হয়রানির পাত্র না করতে চান।”
তৃতীয় একজনের মন্তব্য আরো ভয়াবহ। তিনি পিতামাতাকে উপদেশ দেন তারা যেন তাদের সন্তানকে এই অ্যাপ ব্যবহার করতে না দেয়। কারণ এই অ্যাপ আত্মহত্যার জন্যও প্ররোচিত করতে পারে।
২০১৫ সালে যখন কলেজ ছাত্রছাত্রীদের জন্য এনোনিমাস মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ইক ইয়াক জনপ্রিয় হয়, তখন তদন্ত করে দেখা গিয়েছে যে সেখানে বর্ণবাদসহ নানা ধরণের অশ্লীল মেসেজ পাঠানো হচ্ছে। সেখানে দেখা যায় একজন ছাত্র আরেকজন ছাত্রকে একজন আফ্রিকান ছাত্রী সম্পর্কে বলেছেন, “এসো একে গাছে ঝুলিয়ে দেই।” এর ফলস্বরুপ তাকে পেতে হয় ছয় মাসের সাসপেনশন শাস্তি।
এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশা যাক। যে দেশের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বিভিন্ন স্তরের সেলিব্রিটিদের পোস্টে মানুষ নিজেদের নাম পরিচয় গোপন না করেই নানা ধরণের অশ্লীল কমেন্ট করে থাকে, সেখানে যদি তাদেরকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়া হয়ে থাকে যে ইচ্ছা করলেই সে নাম পরিচয় গোপন করে যা ইচ্ছা বলতে পারে, তাহলে ফলাফল হতে পারে আরো ভয়াবহ। এ যেন ঘৃণা ও অযাচিত মন্তব্য ছড়ানোর এক মিলনমেলা হিসেবে এসেছে। এটা ঠিক যে, যে কোন প্ল্যাটফর্মের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ব্যবহারকারীদের ওপর। তারা কিভাবে এটি ব্যবহার করছে, কি ধরণের ফিডব্যাক দিচ্ছে সেটির ওপরও নির্ভর করে অ্যাপটির কার্যকারিতা। তবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যখন এ ধরণের নেতিবাচক কথা আসে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে, সেখানে আমাদের দেশে কি ধরণের ইতিবাচকতা ফুটে আসতে পারে, তা সম্পর্কে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। মিরা মোহামাদিয়ের টুইটে অসাধারণ একটি কথা বলেছেন তিনি।
“আপনি যদি আমাকে কিছু জানাতেই চান, তাহলে আমার মুখের ওপর বলুন। এনোনিমাস কোন প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে নয়।’
মুদ্রার উল্টোপিঠে থাকে ভিন্ন বাস্তবত্তা। ব্যবহারকারীরা অনেকেই আবার বলছেন আশার বাণীও। কেউ কেউ বলছেন তাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হচ্ছে বন্ধুবান্ধবের কাছ হতে ভালো ভালো কথা শুনে, আবার কেউ কেউ বলছেন বেশ ভালো ভালো পরামর্শও পাচ্ছেন তারা।
নিচে আপনাদের একটি স্ক্রিনশট দেয়া হল, যে স্ক্রিনশটে একজন ব্যবহারকারী তাকে ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়েছেন স্ট্যাটাস আকারে।
প্রযুক্তি আমাদের কাছে একটি আশীর্বাদ। এর ইতিবাচকগুলোই আমাদের নেয়া উচিত। সেটিই আমাদের কাম্য। এনোনিমাস প্ল্যাটফর্মে আমাদের ভালো কাজ করার সুযোগ অনেক রয়েছে। কাউকে আমরা ভালো কথা বলে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে পারি, তার গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারি, তাকে ভালো পরামর্শ দিতে পারি। হেট স্পিচ ছড়ানো, বুলি করা, হয়রানি করা ইত্যাদি কাজগুলো কোন ধরণের ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। সারাহাহ-কে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে আমরা বিশ্বের দরবারে নিজেদের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করি না কেন? বিশ্ব অবাক হয়ে দেখুক, শত নেতিবাচকতার ভিড়েও আমরা এসেছি পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে।
আজ এ পর্যন্তই। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার, স্টেপফিড ডট কম, ফিন্যান্স ইয়াহু ডট কম