বিশ্বকাপ ফুটবলে গোলপোস্টে হাত দিয়ে বল থামানো, প্যাট্রিস এভরাকে উদ্দেশ্য করে বর্ণবাদী মন্তব্য করা, কিংবা ইতালিয়ান ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে কামড়ে দেয়া, লুইস সুয়ারেজের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এরকমই বিতর্কিত কিছু মুহূর্ত। কিন্তু এই সুয়ারেজের জীবনেই আছে এমন এক অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প, যার কাছে চলচ্চিত্রের কাহিনীও হয়তো হার মানতে বাধ্য!
সাত ভাইবোনের সাথে ছোট থেকেই অভাব অনটনকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। মা সান্দ্রো লোকের বাড়িতে মেঝে ধুয়ে দেয়ার কাজ করতেন, বাবা রোডোলফো ছিলেন কুলি। কঠিন এই জীবন হঠাৎ করেই হয়ে উঠল আরও দুর্বিষহ, সাত সন্তান ও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন সুয়ারেজের বাবা। আকস্মিক এই ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পরল সদ্য কৈশোরে পা রাখা সুয়ারেজের উপরে। প্র্যাকটিস মিস দিতে লাগলেন, বাড়ির বাইরে রাত কাটানো, মদ খাওয়াও শুরু করে দিয়েছিলেন। অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়ার সবরকম রাস্তাই খোলা ছিল সুয়ারেজের জন্য।
১৫ বছরের সুয়ারেজের জীবনে তখনই এলেন ১৩ বছরের ব্লন্ডচুলো এক মেয়ে, সোফিয়া বালবি। সোফিয়ার প্রেমে পরেই সুয়ারেজ প্রথমবার অনুভব করেন, ফুটবলটা তাঁকে গুরুত্ব সহকারেই নিতে হবে!
ফুটবল খেলে তখন কত টাকাই বা আর পেতেন, সংসারের খরচ মেটাবার জন্যে তাই রাস্তার সুইপার হিসেবেও কাজ করতে হত সুয়ারেজকে। কিন্তু খালি সংসারে টাকা দিলেই কি আর চলে? সোফিয়াকে নিয়ে যেন ভাল খাবার খেতে পারেন, সেজন্যে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পয়সাগুলোও সযত্নে জমিয়ে রাখতেন!
সবকিছুই যখন সাজানো গোছানো মনে হচ্ছিল, সুয়ারেজের জীবনে তখন এল আরেকটি বড় আঘাত। ২০০৩ সালে নিজের পরিবারের সাথে স্পেনের বার্সেলোনায় চলে আসেন সোফিয়া। বাবাকে হারানোর পর এবার সোফিয়াকেও হারিয়ে মুষড়ে পরেন সুয়ারেজ। খেলাও ছেড়ে দেন মাঝে। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন, একমাত্র এই ফুটবলই পারে তাঁকে সোফিয়ার কাছে নিয়ে যেতে।
ন্যাসিওনালের হয়ে যুব ক্যারিয়ার শুরু করা সুয়ারেজের ক্যারিয়ারের প্রথম নামী ক্লাব আয়াক্স। ডাচ ক্লাবটির হয়ে ৫ বছরে ১১০ ম্যাচে ৮১ গোল করে ক্লাব ফুটবলে নিজের আগমনীবার্তা জানান দেন। আয়াক্সে সুয়ারেজের এই বিধ্বংসী ফর্ম তাঁকে নিয়ে আসে অ্যানফিল্ডে, ইংল্যান্ডের অন্যতম সফল ক্লাব লিভারপুলে। সহজাত গোল স্কোরিং অ্যাবিলিটি দিয়ে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও মাতিয়ে রাখেন সুয়ারেজ, অলরেডদের হয়ে ১১০ ম্যাচে করেন ৬৯ গোল।
এরপর সুয়ারেজ কেবল তরতর করে আরও সামনে এগিয়েছেন। লিভারপুল থেকে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব বার্সেলোনায়, লিওনেল মেসি ও নেইমারের সাথে মিলে গড়ে তুলেছেন তর্কযোগ্যভাবে এই সময়ে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণভাগ। এরই মধ্যে বার্সার হয়ে ৯১ ম্যাচে ৮০ গোল হয়ে গেছে উরুগুইয়ান এই ফরোয়ার্ডের।
ব্যক্তিগত অর্জনের ভাণ্ডারও কম সমৃদ্ধ না সুয়ারেজের। ২০১৩-১৪ মৌসুমে হয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়। ২০১৫-১৬ মৌসুমে লীগে ৪০ গোল করে মেসি ও রোনালদোকে পেছনে ফেলে জিতেছেন সর্বোচ্চ গোলের পুরস্কার পিচিচি ট্রফি। ২০০৯ সালের পর থেকে মেসি ও রোনালদো ছাড়া সুয়ারেজই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পিচিচি ট্রফি ও ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু পুরস্কার জিতেছেন। ২০১৬ ডিসেম্বরে গার্ডিয়ান পত্রিকা সুয়ারেজকে বিশ্বের ৩য় সেরা ফুটবলার হিসেবে অভিহিত করেছিল।
ও হ্যাঁ, কৈশোরে যেই মানুষটার জন্য ফুটবলকে আপন করে নিয়েছিলেন, সেই সোফিয়া বালবিকেই সুয়ারেজ বিয়ে করেছেন ২০০৯ সালে। এই দম্পতির কোল আলো করে এসেছে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তানও। কৈশোরে দারিদ্র্যের কাছে হেরে যেই ভালবাসাকে হারাতে হয়েছিল, সেই দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে ভালবাসার লড়াইয়ে ঠিকই জয়ী হয়েছেন সুয়ারেজ!