২০০৯ সালের আগস্ট মাসের কথা। সবেমাত্র বার্লিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১.৫৫.৪৫ মিনিট সময় নিয়ে মেয়েদের ৮০০ মিটার ফাইনালে স্বর্ণ জিতেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কাস্টার সেমেনিয়া। কোথায় সকলের অভিনন্দনে তার ভেসে যাওয়ার কথা, উল্টো সেমেনিয়াকে নিয়ে শুরু হল লজ্জাজনক এক বিতর্ক। সেমেনিয়ার লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে বিতর্ক!
২০০৯ সালেই আফ্রিকান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ১.৫৬.৭২ মিনিট সময় নিয়ে ৮০০ মিটারে প্রথম হয়েছিলেন সেমেনিয়া। এই দৌড়ের মাধ্যমে সেমেনিয়া তার আগের ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং ৭ সেকেন্ড কমিয়ে নিয়ে আসেন, তাও মাত্র ৯ মাসের মাথায়। তখন থেকেই কিছুটা গুঞ্জন শুরু হয় সেমেনিয়াকে নিয়ে, তবে তখন মূলত তিনি পারফরম্যান্স বর্ধক ড্রাগ ব্যবহার করেন কিনা সেটা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছিল।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এসে সেই টাইমিং যখন আরও ১ সেকেন্ডের বেশি কমিয়ে ফেলেন, তখনই সেমেনিয়াকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কোন নারীর পক্ষে আসলেই এত জোরে দৌড়ানো সম্ভব কিনা, সেমেনিয়া আদৌ নারী কিনা এসব একের পর এক বিতর্কিত প্রশ্ন ছুটে আসতে থাকে তার দিকে।
মাত্র ১০ মাসে ৮ সেকেন্ড টাইমিং কমিয়ে আনার কারণে সেমেনিয়াকে মুখোমুখি হতে হল লিঙ্গ পরীক্ষার। সেমেনিয়াকে খেলা থেকে নিষিদ্ধও রাখা হয় এই সময়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ্যে আসেনি, কিন্তু এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হওয়াটাই তো ছিল সেমেনিয়ার জন্য চরম অপমানের। কিছুটা সবল শারীরিক গঠন আর দৌড়ানোর সহজাত ক্ষমতার কারণে সেমেনিয়াকে এইসব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
কিন্তু এতকিছুর পরেও দমে যাননি সেমেনিয়া, বরং ফিরে এসেছেন আগের চেয়েও আরও ধারালো হয়ে। ১১ মাস নিষিদ্ধ থাকার পর ২০১০ এর জুলাইয়ে আবারো প্রিয় ট্র্যাকে ফেরেন সেমেনিয়া। আর ফিরেই একের পর এক জয়ে মুখ বন্ধ করতে থাকেন নিন্দুকদের।
২০১১ দেগু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সেই ৮০০ মিটারেই আবার বিশ্বমঞ্চে নিজের উপস্থিতি জানান দেন সেমেনিয়া, জেতেন রৌপ্যপদক। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ৮০০ মিটারে হয়েছিলেন ২য়, কিন্তু স্বর্ণজয়ী অ্যাথলেটের বিরুদ্ধে ডোপ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠায় সেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে স্বর্ণ জিতে যাবেন সেমেনিয়া।
লন্ডন অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতাটা যদি কিন্তুর উপর ঝুলে থাকলেও ২০১৬ রিও অলিম্পিকে আর সে সুযোগ দেননি সেমেনিয়া। ১.৫৫.২৮ মিনিট সময় নিয়ে বাকি সবাইকে পেছনে ফেলে ৮০০ মিটারে স্বর্ণপদক জিতে নেনে সেমেনিয়া। যেই দৌড়ের কারণে একদিন তাকে চূড়ান্ত অপমানের শিকার হতে হয়েছিল, সেই দৌড়ের কল্যাণেই তিনি পূরণ করেন একজন অ্যাথলেটের আজন্ম লালিত স্বপ্ন।
এছাড়া ২০১৫ অল-আফ্রিকা গেমসে ৮০০ মিটারে স্বর্ণ জিতেছেন সেমেনিয়া। ২০১৬ আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নশিপে একই দিনে ৮০০ মিটার, ১৫০০ মিটার ও ৪*৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতে রেকর্ডও করেছেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান অ্যাথেলেট।
নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর অনেকেই ভেবেছিলেন সেমেনিয়া হয়তো আর ট্র্যাকেই ফিরতে পারবেন না। কিন্তু সেমেনিয়া শুধু ফেরেনই নি, নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায়, অপমানের জবাব সাথে করে ফিরেছেন। সেমেনিয়া এখন আর সাধারণ কোন অ্যাথলেট নন, হাজারো অ্যাথলেটের অনুপ্রেরণার অপর এক নাম।