ডব্লিউ জি গ্রেস একবার আউট হওয়ার পর ক্রিজ ছেড়ে যেতে না চাইলে আম্পায়ার তাকে ড্রেসিংরুমে ফিরে যেতে বলেন। তখন গ্রেস বলেছিলেন, ‘দর্শকেরা কি বোলারের আউট করার উল্লাস দেখতে এসেছে? দর্শকেরা আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে’। কথাটার মর্মার্থ একদিক থেকে কিন্তু সত্য। যতই ব্যাট বলের ভারসাম্যের কথা বলা হোক, শেষ পর্যন্ত কিন্তু দর্শকেরা চার ছক্কাই দেখতে চান। ব্যাটসম্যানেরা একক নৈপুণ্যে যেমন দর্শকদের আনন্দ দেন, তেমনি জুটি বেঁধে ফিল্ডিং দলকে শাসন করার নজিরও নেহায়েত কম নেই। ক্রিকেট ইতিহাসের তেমনি বিখ্যাত ১০ টি জুটির গল্প থাকছে আপনাদের জন্য। আজ প্রথম পর্বে থাকছে টেস্ট ইতিহাসের বিখ্যাত ৫ টি জুটির কথা।
১) সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনের যে জুটি টিকে আছে আজও:
২০০৬ সালে কলম্বো টেস্টের কথা। ১ম ইনিংসে সফরকারী প্রোটিয়াদের মাত্র ১৬৯ রানে গুটিয়ে দেয়ার পর ব্যাট করতে নেমে ১৪ রানে ২ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা নিজেরাও তখন কাঁপছে। সাউথ আফ্রিকাও তখন উজ্জীবিত, দ্রুত আরও কয়েকটি উইকেট তুলতে পারলে ম্যাচে ফেরা যাবে দারুণভাবে। কিন্তু এরপর যা করলেন লঙ্কান ব্যাটিংয়ের দুই মহীরুহ কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে, তা হয়তো কল্পনাও করেনি প্রোটিয়ারা। দুইজনকে যখন বিচ্ছিন্ন করতে পারল সাউথ আফ্রিকান বোলারেরা, তার মাঝে পার হয়ে গেছে ১৫৭ টি ওভার!
দুজনে মিলে গড়লেন ৬২৪ রানের ম্যারাথন এক জুটি, সনাথ জয়াসুরিয়া-রোশান মহানামার ৫৭৬ রান ছাপিয়ে যেটি হয়ে যায় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে যেকোনো জুটিতে সর্বোচ্চ রানের জুটি। শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই নয়, যেকোনো ধরণের স্বীকৃত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই এটি সর্বোচ্চ রানের জুটি, যে রেকর্ড আগে ছিল বিজয় হাজারে ও গুল মোহাম্মদের ৫৭৭ রানের জুটির দখলে।
ওই ইনিংসে মাহেলা করেছিলেন তার ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৩৭৪ রান, আর সাঙ্গাকারা থেমেছিলেন ২৮৭ রানে। মাত্র ২৬ রানের জন্য ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ড ছুঁতে পারেননি, কিন্তু এই ৩৭৪ রানের ইনিংস দিয়েই ইতিহাসে ঢুকে গেছেন মাহেলা। টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের তালিকায় মাহেলার ইনিংসটি যে চতুর্থ স্থানে আছে! রেকর্ড করেছেন আরও বেশ কিছু। জয়াসুরিয়ার ৩৪০ ছাপিয়ে যেকোনো শ্রীলঙ্কানের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংস মাহেলার দখলে। অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংসও এটি, প্রথমটি ব্রায়ান লারার ওই অতিমানবীয় ৪০০।
এই জুটি গড়ার পথে টেস্টের ২য় দিনে ৩৫৭ রান যোগ করেছিলেন তারা। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক দিনে কোন উইকেট না হারিয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এটি। এই রেকর্ডে অবশ্য অংশীদার আছে আরও একটি জুটি, স্যার গ্যারি সোবার্স ও কনরাড হান্টও একদিনে অবিচ্ছিন্নভাবে ৩৫৭ রান যোগ করেছিলেন।
২) দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের যে জুটি অমর থাকবে চিরকাল:
টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে স্মরণীয় জুটির তালিকা করতে গেলে এই জুটিটি খুব সম্ভবত এক নম্বরেই থাকবে। ঐতিহাসিক ওই জুটি যে ক্রিকেট রুপকথারই অংশ হয়ে গেছে!
২০০১ সালের অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের কথা। অস্ট্রেলিয়া তখন সর্বজয়ী এক দল, প্রতিটি পজিশনে তাদের বিশ্বসেরা সব ক্রিকেটার। কলকাতায় ২য় টেস্টেও তারা ছিল শক্তিশালী অবস্থানে। প্রথম ইনিংসে নিজেরা ৪৪৫ করার পর ভারতকে অল আউট করে দেয় মাত্র ১৭১ রানে। জয় তখন অস্ট্রেলিয়ার কাছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তখনই দ্রাবির-লক্ষ্মণের ঐতিহাসিক ওই জুটি। ২য় ইনিংসে ২৩২ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর জুটি বাঁধেন, বিচ্ছিন্ন হন ৫ম উইকেটে ৩৭৬ রান যোগ করার পর! ওই এক জুটিতেই সঞ্জীবনী সুধা পেয়ে যায় ভারত, ২য় ইনিংসে হরভজন সিংয়ের ঘূর্ণিজাদুতে অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ২১২ রানে অলআউট করে ১৭২ রানে ম্যাচ জিতে যায় ভারত। ওই টেস্টে লক্ষ্মণের খেলা ২৮১ রানের ইনিংসটি বিংশ শতাব্দীর সেরা টেস্ট ইনিংস বলেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
৩) স্পট ফিক্সিং কান্ডে চাপা ট্রট-ব্রডের অবিশ্বাস্য কীর্তি:
অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে! ২০১০ সালে লর্ডস টেস্টে স্টুয়ার্ট ব্রড আর জোনাথন ট্রট যা ভেলকি দেখিয়েছিলেন, তার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি পাকিস্তানি বোলারেরা। মোহাম্মদ আমিরের ঝড়ে ১০২ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন দেড়শ রানের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সেই ইংল্যান্ড কত করে থামল জানেন? ৪৪৬! আর এর পেছনে মূল অবদান ৮ম উইকেট জুটিতে প্রায় ৯৬ ওভার ব্যাট করে ট্রট-ব্রডের করা ৩৩২ রানের জুটিটির। ট্রট নিজের মতই ব্যাট করেছেন, অবাক করে দিয়েছিল স্টুয়ার্ট ব্রডের ব্যাটসম্যান বনে যাওয়াটা। পাকা ব্যাটসম্যানের মত খেলে ১৬৯ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেছিলেন ব্রড।
কিন্তু তারপরেও এই টেস্ট ট্রট-ব্রডের কীর্তির জন্যে নয়, বরং কলঙ্কিত হয়ে আছে সালমান বাট, মোহাম্মদ আমির ও মোহাম্মদ আসিফের স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির জন্য। আজও তাই সেই লর্ডস টেস্টের কথা উঠলে ট্রট-ব্রডের জুটি না, সবার আগে মাথায় চলে আসে পাকিস্তানিদের সেই স্পট ফিক্সিংয়ের কথা।
৪) তামিম-ইমরুলের বিশ্ব রেকর্ড জুটি:
বিশ্ব রেকর্ড গড়া জুটির তালিকায় নাম আছে এক বাংলাদেশি জুটিরও। ২০১৫ সালে খুলনা টেস্টে ২য় ইনিংসে ১ম উইকেটে ৩১২ রান যোগ করেছিলেন তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। কোন টেস্ট ম্যাচের ২য় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে এটিই সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।
তামিম-ইমরুলের ওই রেকর্ড গড়া জুটিতেই খুলনা টেস্টে হার এড়িয়েছিল বাংলাদেশ। ২য় টেস্টে ২৯৬ রান পেছনে থেকে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশকে ইনিংস পরাজয়ই চোখ রাঙাচ্ছিল। কিন্তু এই জুটি শুধু সেই ভয়ই কাটায়নি, বরং ওই জুটির কল্যাণেই ম্যাচ ড্র করতে পেরেছিল বাংলাদেশ।
৫) অবিশ্বাস্য ম্যাককালামে দিশেহারা ভারত:
নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে উপমহাদেশীয় দলগুলো বরাবরই একটু ব্যাকফুটে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালের ওয়েলিংটন টেস্টে ভারত নয়, উল্টো নিউজিল্যান্ডই চলে গিয়েছিল খাদের কিনারায়। সেখান থেকে কিউইদের উদ্ধার করেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও বিজে ওয়াটলিং, তাও এমনভাবে, যা কেউ ভাবতেও পারেনি।
১ম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ইশান্ত শর্মা ও মোহাম্মদ শামির তোপে নিউজিল্যান্ড অলআউট মাত্র ১৯২ রানে। জবাবে আজিঙ্কা রাহানের সেঞ্চুরিতে ভারত তোলে ৪৩৮ রান। ২য় ইনিংসেও ৯৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড তখন কাঁপছে ইনিংস পরাজয়ের শঙ্কায়। তখনই ম্যাককালাম-ওয়াটলিংয়ের ওই অবিশ্বাস্য জুটি। ভারতীয় বোলারদের স্রেফ দিশেহারা বানিয়ে দুজনে মিলে ১২৩ ওভার ব্যাটিং করেছেন! শুধু যে টিকে ছিলেন তা না, রানও যোগ করেছেন ৩৫২ টি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ষষ্ঠ উইকেটে যা ৩য় সর্বোচ্চ জুটি। অতিমানবীয় এই জুটির কল্যাণে হারা ম্যাচ ড্র করে নিউজিল্যান্ড।