খুব বেশিদিন হয় নি, চলচ্চিত্রপ্রেমীরা একটি প্রশ্ন নিয়ে দিন রাত পার করছিলেন। কবে পাবেন তারা সে প্রশ্নের উত্তর?অবশেষে গত ২৮শে এপ্রিল সত্যিই জানা গেল কাটাপ্পা কেন বাহুবালীকে হত্যা করেছিলেন। সাথে সাথে আরো জানা গেল রাজমাতা শিবগামীকে বিপথে নিয়ে যাবার এক কুটিল চক্রান্ত।
তবে দ্বিতীয় কিস্তিতে মধুরেণ সমাপয়েতই ঘটল। মহেন্দ্র বাহুবালী পিতৃহত্যার প্রতিশোধের সাথে মহেস্মতীর সিংহাসনে আরোহণ করলেন, সে সাথে সারা বিশ্ব দেখল দক্ষিণী ছবি বাহুবালীর জয়জয়কার। পরিচালক এস এস রাজামৌলি প্রকৃতপক্ষেই অন্য এক আসনে নিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণী ছবিকে। একইসাথে কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক করে দর্শক মনে। এরকম আন্তর্জাতিক মানের ছবি আসলেই চোখ ও মনের জন্য অন্যধরণের এক আয়াস সৃষ্টি করে। তবে এর পেছনে যদি কোন কাহিনী থাকে, তাহলে তা কেমন হবে? বাহুবালী কি শুধু ছবির চরিত্র নাকি বাহুবালী নামে কোন একটি চরিত্র সত্যিই ছিল?
আসলেই বাহুবালী নামের এক চরিত্র রয়েছে। তবে তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের বাহুবালী নন। তিনি অন্য এক বাহুবালী, যিনি জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তার আগে জানা যাক জৈন ধর্ম সম্পর্কে দুটি কথা।
জৈন ধর্মঃ
জৈন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘জিন’ শব্দটি থেকে, যার মানে হচ্ছে জয়ী। কেমন জয়ী হবেন তারা, যারা জৈন ধর্মের অনুসারী হবেন? আমাদের জানা আছে, মানুষ রিপুর তাড়নায় নানা ধরণের কাজ করে বসে। আবেগ, হিংসা, আসক্তি, ক্রোধ, অহংকার ইত্যাদি ভাবাবেগগুলো থেকে যিনি নিজেকে মুক্তি দান করেছেন, তিনিই জয়ী এবং তাকে বলা হয় ‘জিন’।
জৈন ধর্ম বিশ্বের প্রাচীন ধর্মগুলোর মাঝে অন্যতম। বর্তমান ভারতে এই ধর্মের অনুসারী অনেকাংশে কমে গেলেও সারা বিশ্বে এই ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা অনেক। জৈনরা তাদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থংকরের কথা বলেছেন। এদের মাঝে প্রথম হচ্ছে ঋষভ ও সর্বশেষ হচ্ছেন মহাবীর। অনেকে মহাবীরকেই মনে করে থাকেন জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এটি নিয়ে নানা গবেষণা ও প্রমাণও রয়েছে। তবে আজ আমরা কথা বলব প্রথম তীর্থংকর ঋষভের পুত্র বাহুবালীকে নিয়ে।
ঋষভের পুত্র বাহুবালীঃ
প্রথমেই বলে নিয়েছি, বাহুবালী ছিলেন প্রথম তীর্থংকর ঋষভের পুত্র। তিনি জৈন সময়কালে অবসরপনি যুগে এসেছিলেন। জৈনদের সর্বোচ্চ সম্মান ও পূজনীয়দের মাঝে একজন হলেন বাহুবালী। সিংহাসন নিয়ে তাঁর বড় ভাই ভরতের সাথে এক যুদ্ধের পর তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ধ্যান করবার উদ্দেশ্যে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। যুদ্ধ জয়ী হবার পরেও তিনি তাঁর রাজ্য ভাই ভরতকে দান করে দেন। সন্ন্যাস গ্রহণ করবার পর তিনি জামাকাপড়ও পরিত্যাগ করেন। আমরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে ধ্যান করবার নানা ধরণের ভঙ্গিমা ও আচারের কথা জানি। বাহুবালী দাঁড়িয়ে থেকে এক বছর ধ্যান করবার পর অরিহন্তে পরিণত হন।
যিনি নানা ধরণের আসক্তি ও ভাবাবেগগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন, সংস্কৃত ভাষায় তাকে বলা হয় অরিহন্ত।
জৈন ধর্ম অনুসারে বাহুবালী কৈলাস পর্বতে গিয়ে ‘মোক্ষ’ লাভ করেন। পর্বতে গিয়ে মোক্ষ বা সিদ্ধি লাভ করবার কথা আমরা নানা ধর্মগ্রন্থেও দেখতে পাই।
বাহুবালীর অপর নাম গোমতেশ্বর। এই নামে তাঁর একটি মূর্তি নির্মান করা হয়েছিল ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে। নির্মাণ করেন গঙ্গ রাজবংশের মন্ত্রী ও সেনাপতি চামুন্ডারায়। এই মূর্তিটি বিনা সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিজ খরচে তৈরি করা হয়েছে এমন সব মূর্তির মাঝে বিশ্বে অন্যতম। ২০০৭ সালে মূর্তিটি ভারতের সেরা সাত আশ্চর্যের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার লাভ করে। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত এই মূর্তিটির উচ্চতা ৫৭ ফিট।
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে আদিকবি পম্পা কান্নাড়া ভাষায় ১৬টি অধ্যায়ে ভাগ করে গল্পে ও ছন্দের আকারে মিলিয়ে রচনা করেন আদিপুরাণ। এই আদিপুরাণে বাহুবালী ও তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ভরতের দশটি জীবনের কথা বলা হয়েছে।
মোক্ষ লাভের উপায়ের দ্বার প্রান্তে বাহুবালীঃ
অহংকার ত্যাগ করবার জন্য বাহুবালীকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন তাঁর দু বোন ব্রাহ্মী ও সুন্দরী তাকে বলেন তীর্থংকর আদিনাথের কথা। দিন যায়, মাস যায় কিন্তু বাহুবালী মোক্ষ লাভ করতে পারছেন না। তাঁর শরীর আস্তে আস্তে ধূলা, কীট পতঙ্গের আস্তরণে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মোক্ষ লাভের দ্বারপ্রান্তে এসেও তিনি মোক্ষলাভ করতে পারছিলেন না। কারণ কি?
তীর্থংকর আদিনাথ বলেন, বাহুবালী হস্তী ত্যাগ করতে পারছেন না। হস্তী মানে হচ্ছে নিজেকে নিয়ে বড়াই করা।
চলচ্চিত্রেও দেখেছি আমরা বাহুবালীকে রাজ্য থেকে বিতারণ করে দেবার পর তিনি প্রকারান্তরেই হাতির পিঠ থেকে নিচে নেমে এসে সাধারণ জনসাধারণের কাতারে মিশে যান। গল্পের স্ক্রিপ্ট রাইটাররা কি জৈন ধর্মের এই বাহুবালীর সাথে একটি ফিকশনাল চরিত্রের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন? কে জানে!
আদিনাথের কথা শুনে বোধোদয় হবার পর বাহুবালী তাঁর আত্মম্ভরিতা ছেড়ে দেন এবং মোক্ষ লাভ করেন। এরপর পিতার রাজ্যে ফিরে গেলে তিনি সাধারণে সঠিক পথ দেখাতে শুরু করেন।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে বাহুবালীর একশিলা পাঁচটি মূর্তি রয়েছে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত ও ইন্দোরেও বাহুবালীর বেশ কিছু মূর্তি রয়েছে। প্রতি বছর এখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়।
প্রতিটি পৌরাণিক চলচ্চিত্রের পেছনের কিছু গল্প থাকে। গল্পগুলো ঐতিহাসিক, আবার একইসাথে কিছুটা থাকে কল্পনার মিশেলে গড়া কিছু চরিত্র। তবে বাহুবালীকে নিয়ে যে হাইপটি তৈরি করতে রাজামৌলি সমর্থ হয়েছেন, তার জয়জয়কার অব্যাহত থাকুক। একইসাথে আমাদের মানসপটেও আসুক পর্দার আড়ালের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি।
আজ এ পর্যন্তই। ভালো থাকুন, প্রিয়লেখার সাথে থাকুন, সকলের প্রিয় হয়ে থাকুন।