খেলাধুলার ইতিহাসে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাটা খুব কমন একটা কথা। গুরুত্বের বিচারে প্রতিটি খেলাই সব দলের জন্য সমান, সব খেলাতেই প্রতিটি দল জয়ের জন্যই মাঠে নামে। কিন্তু কিছু কিছু খেলা শুধু জয় পরাজয়ের গণ্ডিতে আটকে থাকে না, বড় হয়ে ওঠে সম্মানের প্রশ্ন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হার কেবল একটি পরাজয়ই নয়, হৃদয়ে যেন শত পরাজয়ের শেল হয়ে বিঁধে। আবাহনী-মোহামেডান, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড; ক্রিকেট-ফুটবলে এরকম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের লড়াই আলাদা এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে দর্শকমনে। শুধু দর্শক কেন, খেলোয়াড়েরাও মুখিয়ে থাকেন এই ম্যাচে নিজেদের সর্বস্ব ঢেলে দিতে।
ক্রিকেটের তো বটেই, খেলাধুলার ইতিহাসেই ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ এক অন্যরকম জায়গা নিয়ে আছে। নিজেদের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক ইতিহাস মিলিয়ে এই ভারত-পাকিস্তান লড়াই পরিণত হয়েছে ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ও আকর্ষণীয় লড়াইয়ে। শোয়েব আখতার একবার বলেছিলেন, বিশ্বকাপ হারলেও ততটা কষ্ট হবে না যতটা ভারতের কাছে হারলে হবে! এই একটি কথা থেকেই বুঝে নেয়া যায় ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের মহিমা।
তবে সম্প্রতি এই লড়াই দর্শককে আর কতটা আকৃষ্ট করতে পারছে, প্রশ্ন উঠে গেছে সেটা নিয়ে। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় দায়টা বোধহয় পাকিস্তানেরই। বিশ্ব আসরে ভারতের কাছে রীতিমত অসহায় আত্মসমর্পণটাকে যে এক প্রকার অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছে তারা!
ওয়ানডে ও টি-২০ বিশ্বকাপ মিলিয়ে এখনো পর্যন্ত মোট ১১ বার মুখোমুখি হয়েছে দুই দল, তাতে পাকিস্তানের জয় নেই একটিও। বৈশ্বিক আসরের মধ্যে এই এক চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই ৩ বারের মোকাবেলায় দুইবার জিতে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে ছিল পাকিস্তান, গত ৪ তারিখ এজবাস্টনে ১২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে জিতে সেখানেও সমতা এনেছে ভারত। বিশ্ব আসরে মোট ১৩ বারের মোকাবেলায় ভারত এগিয়ে ১১-২ ব্যবধানে !
দ্বিপাক্ষিক সিরিজ না হওয়ায় এক বৈশ্বিক আসর ছাড়া ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ পান না ভক্ত-সমর্থকেরা। আর সেখানে এসেই বারবার এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করছে ইনজামাম-ওয়াসিমদের উত্তরসূরিরা। স্বাভাবিকভাবেই তাই দর্শকমনে আবেদন কমে আসছে ঐতিহাসিক এই ম্যাচ ঘিরে।
পাকিস্তান ক্রিকেট যেখানে দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে, সেই একই সময়ে ক্রমাগত উন্নতি করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া দল, ঘরে বাইরে সবজায়গাতেই নিজেদের উন্নতির ছাপ রেখেছে মাশরাফি বাহিনী। দিন দিন আরও আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে বাংলাদেশ, চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে শিখেছে বড় দলগুলোর বিপক্ষে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর দেশের মাটিতেই প্রথমবারের মত ভারতের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ, লড়াই করেছে ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৬ এশিয়া কাপের ফাইনালেও। ২০১২ এশিয়া কাপে ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ, ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে তো জেতা ম্যাচ ১ রানে হেরে গিয়েছিল টাইগাররা। তবে ফলাফল ছাপিয়েও যে জিনিসটা সকলের নজর কেড়েছে, তা হল দুই দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পাকিস্তানের মত এমন অসহায় আত্মসমর্পণ সাম্প্রতিক সময়ে করেনি বাংলাদেশ, বরং ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে নিজেদের ক্রিকেটের ব্র্যান্ডই তুলে ধরেছে বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে।
মিডিয়া কাভারেজ প্রাপ্তির দিকেও আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে এখন বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথ। বিশেষ করে ২০১৫ বিশ্বকাপে নো-বল কাণ্ড ও ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে ১ রানে পরাজয়ের পর থেকে এই দুই দলের ম্যাচ মানেই যেন এক বাড়তি উন্মাদনা। খেলার মান এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুইদিক থেকেই গত দুই-তিন বছরে ভারত-পাকিস্তান লড়াইকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ-ভারত লড়াই। এরকমটা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান না, বরং বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথই হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্রিকেট ম্যাচ, যে ম্যাচ উপভোগ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ।