বিশ্বকাপ শুধু মেসি-রোনালদো-নেইমারদের মতো মহাতারকাদের ঔজ্জ্বল্য ছড়ানোর মঞ্চই নয়, প্রতিবারই বিশ্বকাপ থেকে বের হয়ে আসেন এমন কিছু উদীয়মান তরুণ, পরবর্তী সময়ে যারা বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের তারকাদ্যুতি ছড়ান। ফিফাও এই তরুণ উদীয়মান তরুণদের অনুপ্রাণিত করার জন্য চালু করেছে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পাওয়া পল পগবা এখন ফ্রান্স দলের মূল স্তম্ভ, বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম বড় তারকা। ২০০৬ এ সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পাওয়া লুকাস পোডলস্কি, ২০১০ এ জেতা থমাস মুলার পরবর্তী সময়ে সফল হয়েছেন ক্লাব ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফুটবলে। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিততে পারেন, এমন পাঁচ তরুণ ফুটবলারের উপর চোখ রাখতে পারেন দর্শকেরা।
গ্যাব্রিয়েল হেসুস: ব্রাজিল; বয়স ২১, আন্তর্জাতিক ম্যাচ-১৫, মোট গোল-০৯
এবারের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারের সবচেয়ে বড় দাবিদার ব্রাজিলের নাম্বার নাইন গ্যাব্রিয়েল হেসুস। মাত্র ২১ বছর বয়সেই কোচ তিতের অধীনে ব্রাজিল দলে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন এই স্ট্রাইকার। গত মৌসুমেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেয়া হেসুস প্রথম মৌসুমেই ইংলিশ কন্ডিশনে ৩৯ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ২০ টি। বল কীভাবে জালে ঢুকাতে হয়, সেই রাস্তা ভালোই চেনা আছে হেসুসের। কিন্তু শুধু দুর্দান্ত একজন গোলস্কোরারই নন, তিনি একজন দারুন অ্যাথলেটও, যিনি প্রথম মিনিট থেকে একদম শেষ মিনিট পর্যন্ত এক দমে খেলে যান। তাঁর মুভমেন্টও দারুণ চতুর, যে কারণে তাকে পাহারায় রাখতে হিমশিম খেতে হয় ডিফেন্ডারদের।
জাতীয় দলে নেইমার ও কুটিনহোর সাথে মিলে গড়ে তুলেছেন সময়ের অন্যতম ভয়ংকর ত্রয়ী। খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী দুই উইংয়েই মানিয়ে নিতে পারেন। হেসুসের দুর্দান্ত স্কিল ও গতির কারণে খেলার মাঝেই একাধিকবার জায়গা বদল করতে পারেন এই ত্রয়ী, এতে করে প্রতিপক্ষের কৌশলেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। ম্যান টু ম্যান মার্কিং করবে, নাকি জোনাল মার্কিং করবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গলদঘর্ম হতে হয় প্রতিপক্ষ কোচকে। ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের মধ্যে এরই মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন হেসুস, এবং ২১ বছর বয়সী এই উদীয়মান তারকার কাছ থেকে ২০০২ এর রোনালদোর মতো বিস্ময়কর পারফরম্যান্সের প্রত্যাশা রাখতে শুরু করে দিয়েছেন তারা। শুনতে বেশ চাপের মনে হতে পারে, তবে হেসুসের নিশ্চিতভাবেই সেই সামর্থ্য রয়েছে। হেসুসের ফর্ম ও গোল স্কোরিং দক্ষতার কারণেই হয়তো লিভারপুলের হয়ে দারুণ মৌসুম কাটানো রবার্তো ফিরমিনোকে বেঞ্চে বসে থাকতে হতে পারে।
সর্বশেষ কোন ব্রাজিলিয়ানের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জয়ের নজির সেই ৬০ বছর আগে, ১৯৫৮ সালে পুরষ্কারটি চালুর মৌসুমেই জিতেছিলেন পেলে। হেসুস কি পারবেন পেলের পর দ্বিতীয় ব্রাজিলিয়ান হিসেবে এই পুরষ্কার জিততে?
কিলিয়ান এমবাপ্পে: ফ্রান্স; বয়স ১৯, আন্তর্জাতিক ম্যাচ- ১২, গোল- ০৩
বর্তমান বিশ্বের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় কে, এই প্রশ্নে বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধাদের উত্তরেই হয়তো আসবে একটি নাম, কিলিয়ান এমবাপ্পে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে ১২ টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন এমবাপ্পে।
এমবাপ্পেকে এরই মধ্যে ভবিষ্যৎ থিয়েরি অঁরি হিসেবে দেখছেন অনেকেই। বয়স মাত্র ১৯ হতে পারে, তবে এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন নিজেকে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রেঞ্চ লীগের সেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর ক্ষিপ্রতা, স্পেস খুঁজে নেয়ার দক্ষতা ও গোলক্ষুধা ফ্রন্ট থ্রি পজিশনের যেকোনোটিতে খেলতে সহায়তা করে এমবাপ্পেকে।
সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জেতার ক্ষেত্রে বাজিকরদের প্রথম পছন্দ এই এমবাপ্পে। ফ্রান্সকে এবারের আসরের অন্যতম ফেভারিট ভাবা হচ্ছে, আর সেক্ষেত্রে ফ্রান্সের অন্যতম বড় ভরসা হতে পারেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। বিশ্বকাপের মতো একটি বিশেষ টুর্নামেন্টে এমবাপ্পের মতো একজন বিশেষ প্রতিভা জ্বলে উঠলে ফ্রান্সের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা যে আরও উজ্জ্বল হবে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আলেক্সান্ডার আইওবি: নাইজেরিয়া; বয়স ২২, আন্তর্জাতিক ম্যাচ- ১৫, গোল- ০৪
বিখ্যাত ফুটবলার জে জে ওকোচার ভাগ্নে হওয়ায় পুরো নাইজেরিয়ার মানুষের আশা ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন আর্সেনালের আলেক্সান্ডার আইওবি। যুব পর্যায়ে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করলেও পরবর্তীতে নাইজেরিয়া সিনিয়র দলের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সেই বেশ পরিণত ফুটবল মস্তিষ্কের অধিকারী আইওবি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দারুণ খেলেছেন আইওবি, মূল পর্বেও তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকবে নাইজেরিয়া। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা, আইসল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার মতো দলের সাথে এক গ্রুপে থাকায় আইওবির দায়িত্বটাও তাই বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। আর্জেন্টিনা গ্রুপ ফেভারিট সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই, কিন্তু গ্রুপের দ্বিতীয় স্পটটির জন্য বেশ ভালো লড়াই হবে বাকি তিন দলের মধ্যে। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে একটি গোলের মাধ্যমেই ম্যাচের রঙ বদলে দিতে পারেন আইওবি। আর তা করতে পারলে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জয়ের সম্ভাবনাও উজ্বল হবে আইওবির।
ডেভিনসন সানচেজ: কলম্বিয়া; বয়স ২১, আন্তর্জাতিক ম্যাচ- ০৮, ক্লীন শীট- ০১
২০১৬-১৭ মৌসুমে আয়াক্সের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পরেই অনেকে বুঝে গিয়েছিলেন, ভবিষ্যতের জন্য দারুণ এক প্রতিভা হতে যাচ্ছেন ডেভিনসন সানচেজ। মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো ইউরোপে খেলেই আয়াক্সের মতো দলের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়াটা মোটেও কোন সহজ কাজ ছিল না। বুঝাই যাচ্ছিল তরুণ এই প্রতিভাকে ধরে রাখতে পারবে না আয়াক্স, হয়েছেও তাই। মাত্র ৫ মিলিয়ন ইউরোতে কিনে আনা সানচেজকে ৩৮ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করেছে ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম হটস্পারের কাছে। ইংলিশ ফুটবলের সাথেও খুব দ্রুতই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন তিনি, টবি অল্ডারওয়াইল্ডের অনুপস্থিতিতে স্পার্সদের ডিফেন্স সামলেছেন আস্থার সাথেই।
হোসে প্যাকারম্যানের কলম্বিয়া দলে এখনো পর্যন্ত আটবার প্রথম একাদশে জায়গা পেয়েছেন সানচেজ। আসন্ন বিশ্বকাপেও কলম্বিয়ার ডিফেন্স লাইনের অন্যতম বড় ভরসার নাম তিনি।
জাপান, পোল্যান্ড ও সেনেগালের সাথে এক গ্রুপে পড়া কলম্বিয়াকে পরের পর্বে উঠতে হলে ডিফেন্স লাইনটাকে যথেষ্ট সলিড রাখতে হবে। নিজের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়ে যদি সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটা জিতেই যান, ১৯৮২ বিশ্বকাপে ম্যানুয়েল অ্যামোরোসের পর তিনি হবেন সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জেতা প্রথম ডিফেন্ডার।
হার্ভিং লোজানো: মেক্সিকো; বয়স ২২, আন্তর্জাতিক ম্যাচ- ২৫, মোট গোল- ০৭
বর্তমান বিশ্বের তরুণ ফরোয়ার্ডদের মধ্যে যে কয়জন সাড়া ফেলেছেন, তাদের মধ্যে একজন মেক্সিকোর হার্ভিং লোজানো। ২০১৪ সালে মেক্সিকান ক্লাব পাচুকার হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করা লোজানো জাতীয় দলে প্রথম ডাক পান ২০১৬ সালে। ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ম্যানচেস্টার সিটির মতো ক্লাবকে তাঁর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি যোগ দেন পিএসভি আইন্দহোফেনে। পিএসভির হয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছিলেন তিনি, মাত্র ২৯ লীগ ম্যাচেই করেছিলেন ১৭ গোল।
বাছাইপর্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোল করে সবার আলোচনায় এসেছিলেন লোজানো। এই বিশ্বকাপে মেক্সিকোকে আলো ছড়াতে হলে জ্বলে উঠতে হবে হার্ভিং লোজানোকেও। আর এতে করে তাঁর সেরা তরুণ খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে অনেকটা।
স্পোর্টসকীড়া অবলম্বনে