সভ্যতার সূচনা বলুন কিংবা ধ্বংস সবসময়ই তা এসেছে ভয়ংকর যুদ্ধের পটভূমিতে। আর এই যুদ্ধে যেমন উঠে এসেছে অনেক নায়কোচিত বীরের নাম।তেমনি ইতিহসের পাতায় অনেকে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। কারণ ইতিহাস সবসময় বিজয়ী যোদ্ধাদের কথা মনে রাখে। আজকের ‘প্রিয়লেখায়’ আমরা তুলে ধরছি এমন কিছু যোদ্ধার কথা যারা নানা কারণে যতটা বিখ্যাত তারচেয়েও কুখ্যাত।
চলুন পরিচিত হই তেমন কিছু যোদ্ধার সাথেঃ
মার্কাস ক্যাসিয়াস স্কাইভঃ
রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কঠোর যোদ্ধা হিসেবে ধরা হয় মার্কাস ক্যাসিয়াস স্কাইভ কে। সম্রাট সিজারের সৈন্যদলের একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা হিসেবে তিনি ছিলেন শীর্ষে। যখনই সময় পেতেন তখনই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের সাথে যুদ্ধ প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন। দিরহাসিয়ামের যুদ্ধ, যেখানে জুলিয়াস সিজার ও গিনিয়াস পম্পেই এর নেতৃত্বে প্রায় সকল সভাসদই অংশ নিয়েছিলেন সে যুদ্ধে মার্কাস সামনে থেকে লড়াই করেন। যুদ্ধে মার্কাসের চোখে তীরবিদ্ধ হয় ও তিনি মারাত্মক আহত হন। তীরবিদ্ধ হয়ে অন্ধ হয়ে গেলেও, রণহুংকার দিয়ে তিনি তখন আরও ভয়াবহ ভাবে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার ঢালে শতেক তীর বিদ্ধ ছিল বলে কথিত রয়েছে। পরবর্তীতে আরও দুটি তীর এসে একটি তার গলায় ও অপরটি তার হাঁটুতে বিদ্ধ হয়।তবু তিনি হার মানেন নি। তিনি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যু আসা না পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে নিজের সীমা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।
মেল্যানকোমাস অফ কারিয়াঃ
‘মেল্যানকোমাস অফ কারিয়া’- ছিলেন তুরস্কের এক প্রাচীন মুষ্টিযোদ্ধা (Boxer)। যদিও তিনি কখনো তলোয়ার চালিয়েছেন কি না জানা যায় নি ,তবে এতটুকু জানা যায় যে কোন প্রতিপক্ষ কখনো তাকে ছুঁতে পারে নি। একজন বিশেষ মুষ্টিযোদ্ধা যার কাজ ছিল মুঠোর আঘাতে প্রতিপক্ষকে ক্ষতবিক্ষত ও পরাস্ত করা, তার বিরুদ্ধে গুজবের কিন্তু কোন অন্ত ছিল না। মেল্যানকোমাস কে নিয়ে এমনই এক কিংবদন্তি ছিল, যে তিনি যদি কোন কিছুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলে তিনি একাগ্রতার সাথে না খেয়ে না ঘুমিয়ে বিন্দুমাত্র নড়াচড়া না করে দুইদিন কাটিয়ে দিতে পারতেন।
তিনি এমন এক কৌশল খাটিয়ে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন যা আজও কিংবদন্তীতুল্য। তিনি তার প্রতিপক্ষকে কখনো আঘাত করার প্রয়োজনই বোধ করেন নি, কারণ জীবদ্দশায় কোন প্রতিপক্ষ তাকে ছুঁতে পারেন নি।
ফ্ল্যামাঃ
ফ্ল্যামা, বা “দ্য ফ্লেম” প্রাচীন রোমান গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। মঞ্চে নাটকীয় নামের গুরুত্ব সম্পর্কে হাজার হাজার বছর আগেই ফ্ল্যামা জানতেন। পরবর্তীতে ফ্ল্যামার কাহিনী থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে জনপ্রিয় রেসলার ডোয়েন জনসন নিজের মঞ্চ নাম রাখেন দ্য রক।
তখন ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি গ্ল্যাডিয়েটরর স্বপ্ন ছিল দারিদ্রতার হাত মুক্তি পাওয়া, মালিকদের দাসত্বের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করা, জীবনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু, ফ্ল্যামা’র দৃষ্টি ভঙ্গি ছিল খানিকটা ভিন্ন। ফ্ল্যামা’র চাহিদা ছিল একটাই, ‘খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন।’
ফ্ল্যামা চারবার তার স্বাধীনতা অর্জন করেছেন! কিন্তু তিনি তীব্রভাবে এটি গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করেন। বলতেই হবে খ্যাতি সবার জন্য বিড়ম্বনা নয়।
জিয়াহু ডুনঃ
জিয়াহু ডুন শুধুমাত্র একজন কুখ্যাত যোদ্ধাই ছিল না, ছিল সর্বোচ্চ স্তরের একজন সাইকোপ্যাথ। শুরুতে সামরিক বাহিনীর এই সেনাপতি ,পূর্ব হান রাজবংশের শাসক কাও কাও এর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯০ শতকের শেষের দিকে তিনি কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন যখন এক যুদ্ধের সময় তিনি একটি দিকভ্রান্ত তীর দ্বারা আক্রান্ত হন এবং বাম চোখ হারিয়ে বসেন। পরবর্তী ঘটনা আরও লোমহর্ষক। নিজের চোখে গেঁথে থাকা তীর তিনি বের করে আনেন যাতের তার নিজের অক্ষিগোলক সংযুক্ত ছিল। তিনি তার সৈনিকদের সামনেই নিজের অক্ষি গোলোক গিলে ফেলেন। কি নৃশংস ঘটনা। খানিকটা চিন্তা করেই দেখুন।
কেউ আগে কখনও এমন ঘটনার মুখোমুখি হন নি। এরপর থেকে সমগ্র চীন একচোখা জিয়াহু’র নামে আতঙ্কে কেঁপে উঠতো। তার মুখোমুখি হবার সাহস প্রতিপক্ষ সৈন্যদলের মাঝে খুব কমই ছিল।
অ্যারিস্টোডেমাসঃ
‘থ্রী হান্ড্রেড’ চলচিত্রটির কথা মনে আছে! অ্যারিস্টোডেমাস ছিলেন ‘ থ্রী হান্ড্রেড’ চলচ্চিত্রটির একজন পার্শ্ব চরিত্র । ছবিতে, তাকে ডিলিয়াস নামে নামকরণ করা হয়, এবং সেই ব্যক্তি যিনি তার চোখ হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে তিনি পালিয়ে বাকি স্পার্টান সেনাবাহিনীর অন্যত্র মিলিত হন। যখন তিনি অসহ্য সংক্রমণের কারণে তার চোখ হারিয়ে ফেলেন তখন নিতান্ত একজন কাপুরুষের মতো যুদ্ধে লড়তে অস্বীকৃতি জানান। সুতরাং চলচ্চিত্রটি চিত্রায়নে সত্যের অর্ধেক ছোঁয়া পেয়েছে।
তবে, স্পার্টানরা অ্যারিস্টোডেমাস এর পালিয়ে আসাকে সুনজরে দেখে নি। তারা তাকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করার সিদ্ধান্ত নিতেই চলেছিল এমন সময় প্লাটিয়া’র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই অ্যারিস্টোডেমাস এই যুদ্ধে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতই প্রতিপক্ষের শিবিরে তান্ডব লীলা চালায়।যেন সে আত্মহত্যার নেশায় মত্ত ছিল। তার এই মরণপন লড়াই দেখে স্পার্টানরা তাকে ক্ষমা করে দেয় এবং মৃত্যু পরবর্তী তাকে সসম্মানে দাফন করে। একচোখা কাপুরুষের বীরের মত সসম্মান মৃত্যু আজও ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।
ইতিহাস সবসময় বিজয়ের গান গায়, বিজয়ীর গান গায়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে রয়েছে শত সহস্র বীর যোদ্ধা। তাদের নিয়ে আবারো আমরা ফিরবো ‘প্রিয়লেখার’ পাতায়। আমাদের সাথেই থাকুন।