‘আমি খুব ক্লান্ত’- মাত্র এই তিনটি শব্দ দিয়ে শেষ হয়ে গেলো আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ও সব্যসাচী ব্যাটসম্যান আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্সের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। মাত্র চারদিন আগেই আরসিবির হয়ে আরেকটি আইপিএল মৌসুম শেষ করে আসা ডি ভিলিয়ার্স যে এমন ঘোষণা দিয়ে বসবেন, তা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি কেউ।
নিজের অফিশিয়াল সাইটে একটি ভিডিও আপলোড করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা সবাইকে জানিয়েছেন ডি ভিলিয়ার্স। ভিডিওবার্তায় বলেছেন, ‘আমি সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১১৪ টি টেস্ট ম্যাচ, ২২৮ টি ওয়ানডে ও ৭৮ টি টি-২০ ম্যাচ খেলার পর এখন সময় হয়েছে অন্য কারোর আমার জায়গা নেয়ার। আমি আমার সুযোগ পেয়েছি, এবং সত্যি বলতে, আমি খুব ক্লান্ত।
এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। আমি অনেক সময় নিয়ে ভেবে দেখেছি। মানসম্মত ক্রিকেট খেলতে খেলতেই আমি বিদায় নিতে চেয়েছি। ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত সিরিজ জয়ের পর আমার মনে হয়েছে, সরে দাঁড়ানোর এখনই সেরা সময়।’
‘বেছে বেছে ক্রিকেট খেলাটা আমার কাছে ন্যায্য মনে হচ্ছিল না। আমার হিসাব একটাই, খেললে সবকিছু খেলবো, নাহলে কিছুই খেলবো না। এতগুলো বছর ধরে আমাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য কোচ ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের সকল সাপোর্ট স্টাফের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। সবচেয়ে বড় ধন্যবাদটা পাবে আমার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে যতজনকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছি তাঁরা। ওদের সমর্থন না পেলে আজ আমি যা হয়েছি, তার অর্ধেকও হতে পারতাম না।’
‘আমার মনে হয়েছে এখনই উপযুক্ত সময়। সবকিছুরই একটা সমাপ্তি আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্তদের বলবো, আপনাদের সমর্থন ও উদারতার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আর আজকে, আমাকে বোঝার জন্য, আমার সিদ্ধান্তকে বোঝার জন্য।’
‘বিদেশে খেলার কোন পরিকল্পনা নেই আমার। আশা করছি ঘরোয়া ক্রিকেটে টাইটানসের হয়ে খেলে যেতে পারবো আমি। ফাফ ডু প্লেসি ও প্রোটিয়া দলের সবচেয়ে বড় সমর্থক আমিই থাকবো।’
ডি ভিলিয়ার্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রথম গুঞ্জন শুরু হয় ২০১৫ এর শেষের দিকে, ভারতের মাটিতে ভারতের কাছে ৩-০ তে বিধ্বস্ত হওয়ার পরে। র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর জায়গাটি হারাতে হয়, বিদেশের মাটিতে নয় বছর কোন সিরিজ না হারার রেকর্ডটিও ক্ষুণ্ণ হয় ওই সিরিজ হারের মাধ্যমেই। এরপর দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম টেস্টে ডি ভিলিয়ার্সকে উইকেটকিপিং করার কথা বলা হয়।
ওই ম্যাচের সময়েই প্রথমবার রিপোর্ট বের হয় যে ডি ভিলিয়ার্স আগেভাগেই অবসরের কথা ভাবছেন। সেই সময়ে অবসরের কথা উড়িয়ে দিলেও ফরম্যাট বাছাই করে খেলার কথা তখনই জানিয়েছিলেন তিনি।
ইংল্যান্ড সিরিজেরই দ্বিতীয় টেস্টের পর হাশিম আমলা অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে ডি ভিলিয়ার্সকে সিরিজের বাকি অংশের জন্য ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক করা হয়। অধিনায়কত্ব নিয়ে ডি ভিলিয়ার্সের বাসনার কথা অজানা ছিল না, ২০১৪ সালে গ্রায়েম স্মিথের অবসরের পর তাঁকে অধিনায়ক না বানানোয় নিজের হতাশার কথা খোলাখুলিই জানিয়েছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকাপাকিভাবে টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পেলেও তিনি সেটা সেভাবে প্রয়োগ করার সুযোগই পাননি। আগস্টের দিকে কনুইয়ের ইনজুরিতে পড়ায় সেটার অপারেশন করাতে হলো, পুনর্বাসনের জন্য মাঠের বাইরেও থাকতে হলো অনেকটা সময়। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ মিস করলেন, ওই সিরিজেই ফাফ ডু প্লেসির নেতৃত্বে নিজেদের নতুন করে গোছানোর শুরু সাউথ আফ্রিকার। নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরও মিস করলেন ডি ভিলিয়ার্স, তাঁকে এবং ডেল স্টেইনকে ছাড়াই অস্ট্রেলিয়া থেকে সিরিজ জিতে ফিরলেন ডু প্লেসি।
ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কা সিরিজের আগে ডু প্লেসির হাতে টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন ডি ভিলিয়ার্স। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে চাওয়ায় ২০১৭ সালের বেশিরভাগ সময়ই টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন তিনি, বছরের শেষ ভাগে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবশ্য খেলেছেন।
তাঁকে ছাড়া খেলেই নিউজিল্যান্ড থেকেও সিরিজ জিতে ফেরে প্রোটিয়ারা। জুনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অধিনায়ক ছিলেন তিনিই। সাউথ আফ্রিকা গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়লেও তিনি ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
তবে এরপর আশ্চর্যজনকভাবে ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্বও ডু প্লেসির কাছে ছেড়ে দেন ডি ভিলিয়ার্স। ২০১৭ এর ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চার দিনের টেস্টের আগে ডু প্লেসি আঙুলের ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে না পারায় আবারও টেস্ট দলের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পান ডি ভিলিয়ার্স।
ভারতের বিপক্ষে তিন টেস্ট ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চার টেস্ট সিরিজের সবকয়টিতেই অংশ নেন তিনি। দুটো সিরিজই জেতে সাউথ আফ্রিকা। গত বছর খেলা ৮ টেস্টে ৭ টি ফিফটি ও ১ টি সেঞ্চুরি করেছেন ডি ভিলিয়ার্স।
এই বছরেরই ৮ মার্চ কেন্দ্রীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপকে মাথায় রেখে এগোচ্ছেন, এমনটাই ধারণা ছিল সবার। কিন্তু গত মাসে হঠাৎ করেই ডি ভিলিয়ার্স ইঙ্গিত দেন, পরের বিশ্বকাপ তাঁর কাছে দূরের বাতিঘরই মনে হচ্ছে। আইসিসি ওয়েবসাইটকে বলেন, ‘আমি এক ম্যাচ এক ম্যাচ করে ভাবছি। বিশ্বকাপ জেতা আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। আমি আমার লক্ষ্য পরিবর্তন করেছি। জিততে পারলে খুবই খুশি হব, সেটা হবে আমার জন্য বোনাস। কিন্তু বিশ্বকাপ না জিতলেও সেটি আমার ক্যারিয়ারে তেমন প্রভাব ফেলবে না।’
বিদায়বেলায় অনেকগুলো রেকর্ডকে সাথে নিয়েই যাচ্ছেন আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম এই গ্রেট। টেস্ট ক্রিকেটে সাউথ আফ্রিকার চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি, ওয়ানডেতে দ্বিতীয়। ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড তাঁর। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, ডি ভিলিয়ার্স সবার মনে জায়গা নিয়ে থাকবেন তাঁর নিখাদ বিনোদনময়ী ব্যাটিং শিল্পের কারণে। স্ট্রোক প্লেকে যেন এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি, একা হাতে ম্যাচ জেতানোর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। এমন সব শট খেলতেন, যা অন্য কেউ চিন্তাও করতে পারতো না। আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স তাই সকলের মনে থেকে যাবেন তাদের প্রিয় ‘সুপারম্যান’ হয়েই, ক্রিকেট মাঠে যার কাছে অসাধ্য কিছুই নেই!
এক নজরে ডি ভিলিয়ার্সের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার:
ম্যাচ | রান | গড় | স্ট্রাইক রেট | সেঞ্চুরি/ফিফটি | সর্বোচ্চ | |
টেস্ট | ১১৪ | ৮৭৬৫ | ৫০.৬৬ | ৫৪.৫১ | ২২/৪৬ | ২৭৮* |
ওয়ানডে | ২২৮ | ৯৫৭৭ | ৫৩.৫০ | ১০১.০৯ | ২৫/৫৩ | ১৭৬ |
টি-২০ | ৭৮ | ১৬৭২ | ২৬.১২ | ১৩৫.১৬ | ০/১০ | ৭৯* |