জন্মগতভাবেই বাকিদের চেয়ে শারীরিকভাবে একটু আলাদা ছিলেন তিনি। কিছুটা S আকৃতির মেরুদণ্ড ও দুটি অসমান পা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই অসমান পা নিয়ে খেলেই তিনি স্থান পেয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের ছোট্ট তালিকাতেও। নিজ দেশ ব্রাজিলে তিনি এতটাই জনপ্রিয়, যে তাঁর জনপ্রিয়তার কাছে পেছনে পড়ে যান স্বয়ং ফুটবল সম্রাট পেলেও!
বলা হচ্ছে ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো ডস সান্তোসের কথা। কি চিনতে পারলেন না? না-ই চিনতে পারেন। গোটা ফুটবল বিশ্বই যে তাঁকে চেনে গারিঞ্চা নামে! সেই গারিঞ্চা, এক পা ছোট নিয়ে জন্মেও যিনি অনেকের চোখেই সর্বকালের সেরা ড্রিবলার।
গারিঞ্চা নামটা তাঁর বোনের দেয়া। একটু বড় হলে গারিঞ্চার বোন রোসা খেয়াল করলেন, তার ভাই সমবয়সী অন্য শিশুদের থেকে খাটো। সে কারণে একটি ছোট পাখির নামের সাথে মিলিয়ে তিনি ভাইকে ডাকতে শুরু করলেন গারিঞ্চা। সেই থেকে তিনি পরিবার ও বন্ধুমহল সর্বত্রই গারিঞ্চা নামেই জনপ্রিয়।
১৯৫৩ সালে যখন বোটাফোগোতে যোগ দিলেন, গারিঞ্চা ততদিনে বিয়ে টিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে বসে আছেন! প্রথম ট্রেনিং সেশনেই ব্রাজিল জাতীয় দলের ডিফেন্ডার নিল্টন সান্তোসের পায়ের ফাঁক দিয়ে ড্রিবলিং করে সবাইকে মুগ্ধ করে দেন গারিঞ্চা। মূল দলে প্রথমবার সুযোগ পেয়েই করলেন হ্যাটট্রিক।
বোটাফোগোতে দুর্দান্ত খেলতে থাকলেও ব্রাজিল জাতীয় দলে তাঁর পজিশনে খেলার জন্য আরও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আগে থেকেই ছিলেন। মূলত জুনিনহো থাকার কারণেই ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিল স্কোয়াডে জায়গা পাননি গারিঞ্চা। তবে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে আর গারিঞ্চাকে উপেক্ষা করতে পারেননি নির্বাচকেরা। ১৯৫৭ সালে লীগে ২৬ ম্যাচে ২০ গোল করে বোটাফোগোকে করলেন চ্যাম্পিয়ন, নিজে হলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা।
তবে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের শুরুর দুই ম্যাচে এক অদ্ভুত কারণে একাদশে জায়গা হয়নি গারিঞ্চার। বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে ইতালির বিপক্ষে এক ম্যাচে পাঁচ ডিফেন্ডার ও গোলকিপারকে কাটিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম দর্শনীয় এক গোল করেন গারিঞ্চা। কিন্তু এই গোলে মুগ্ধ হননি গারিঞ্চার কোচ, বরং এভাবে ড্রিবল করাকে তাঁর কাছে অবিবেচকের মত কাজ বলে মনে হয়েছিল! যে কারণে বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে বেঞ্চেই বসে থাকতে হয় গারিঞ্চাকে।
তৃতীয় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে একসাথে বিশ্বকাপ অভিষেক হল পেলে ও গারিঞ্চার। ওই ম্যাচের একদম শুরু থেকেই আক্রমণে গিয়েছিল ব্রাজিল। শুরুর তিন মিনিট এতটাই দাপট দেখিয়েছিল তারা যে ইতিহাসেই তা পরিচিত হয়ে আছে ‘ফুটবলের সর্বকালের সেরা ৩ মিনিট’ হিসেবে।
ফাইনালে ব্রাজিলের সামনে সুইডেন, ব্রাজিলের সামনে তখন নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধাক্কা খেল সুইডেন শুরুতেই এক গোলে এগিয়ে গেলে। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের স্বপ্নে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করেন সেই ‘লিটল বার্ড’ গারিঞ্চা। ভাভাকে দিয়ে দুই গোল করালেন, ব্রাজিলও তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ জিতল ২-১ গোলে। গারিঞ্চা হলেন বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, মনোনীত হলেন বিশ্বকাপের সেরা একাদশেও।
তবে দুর্দান্ত এক বিশ্বকাপ কাটানোর পরেই টালমাটাল হয়ে পড়ে গারিঞ্চার ব্যক্তিগত জীবন। মদ্যপানের কারণে অতিরিক্ত মুটিয়ে গেলেন, ফলে বাদ পরলেন জাতীয় দল থেকে। বোটাফোগোর হয়ে সুইডেন সফরে গিয়ে সেখানে এক স্থানীয় মেয়েকে গর্ভবতী বানিয়ে ফিরে আসেন। ব্রাজিলে ফিরে ঘটিয়ে বসেন আরেক গুরুতর কাণ্ড, নিজের বাবাকে গাড়ি চাপা দিয়ে বসেন! পুলিশ যখন তাঁকে আটক করে, তখন তিনি মদের ঘোরে একদম বেসামাল, এতটাই বেসামাল যে তিনি কি কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন সে ব্যাপারেও তাঁর কোন হুশ নেই!
তবে বেসামাল জীবন সামলে নিয়ে পরের বিশ্বকাপেই নিজের জাত আবারো চিনিয়ে দেন গারিঞ্চা। ইনজুরির কারণে প্রথম দুই ম্যাচেই শেষ হয়ে যায় পেলের বিশ্বকাপ, তারপরেও ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জিততে এতটুকু অসুবিধা হয়নি, গারিঞ্চা যে ছিলেন! ওই বিশ্বকাপকে এক কথায় বর্ণনা করতে হলে ‘গারিঞ্চার বিশ্বকাপ’ বলে দিলেই চলে, এতটাই দুর্দান্ত ছিলেন তিনি।
পেলে ইনজুরিতে বাইরে যাওয়ার পর ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ স্পেনের বিপক্ষে। ৫ মিনিট বাকি থাকতে স্কোর ১-১, এমন সময় গারিঞ্চা ম্যাজিক। রাইট ফ্ল্যাঙ্কে বল পেয়ে এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে থেমে থাকলেন, ওই ডিফেন্ডার আবার দৌড়ে এলে আবার তাঁকে ড্রিবল করলেন, তারপর আরেকজনকে কাটিয়ে ক্রস করলেন আমারিলদোর উদ্দেশ্যে (পেলের বদলে আমারিলদোই খেলেছিলেন বাকি টুর্নামেন্ট), সেই ক্রস থেকে আমারিলদোর গোল।
কোয়ার্টার ফাইনালে গারিঞ্চা নিজে করলেন দুই গোল, আরেকটি করালেন ভাভাকে দিয়ে, ব্রাজিলও ইংল্যান্ডকে হারালো ৩-১ গোলে। সেমিফাইনালেও গারিঞ্চার জোড়া গোল, ব্রাজিলও চিলিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত ফাইনালে। ওই ম্যাচে গারিঞ্চার খেলা দেখে চিলিয়ান এক পত্রিকা শিরোনাম করেছিল, ‘গারিঞ্চা কোন গ্রহ থেকে এসেছেন?’
ওই ম্যাচের ৮৩ মিনিটে অবশ্য বারবার ফাউলের শিকার হয়ে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখেছিলেন গারিঞ্চা, কিন্তু ফাইনালের জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়নি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ চেকোস্লোকাভিয়া, প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও ম্যাচটা খেললেন গারিঞ্চা, এবং শুধু খেললেনই না, ৩-১ গোলের জয়ে ব্রাজিলকে এনে দিলেন টানা দ্বিতীয় শিরোপা। মূলত এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স দিয়েই ব্রাজিলের মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন ‘বাঁকানো পায়ের দেবদূত’।
ব্রাজিলের জার্সি গায়ে কেবল একটিই ম্যাচ হারের স্বাদ পেয়েছেন গারিঞ্চা, সেটি ১৯৬৬ বিশ্বকাপে। গুডিসন পার্কে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারে ব্রাজিল, সেটিই ছিল ব্রাজিলের জার্সি গায়ে গারিঞ্চার শেষ ম্যাচ। এই বিশ্বকাপেই বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে একটি করে গোল করেন পেলে ও গারিঞ্চা, একই ম্যাচে এই দুই গ্রেটের গোল করার এটিই প্রথম ও একমাত্র ঘটনা।
গারিঞ্চা যেমন ব্রাজিলের, ঠিক ততটাই বোটাফোগোর। ক্লাবটির নামের সমার্থকই হয়ে গেছেন তিনি। ১২ বছর কাটিয়েছেন ক্লাবটিতে, জিতিয়েছেন তিনটি লীগ শিরোপা, ৫৮১ ম্যাচে করেছেন ২৩২ গোল। তবে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর তাঁর পড়তি ফর্মের কারণে করিন্থিয়ান্সে বিক্রি করে দেয়া হয় গারিঞ্চাকে।
ফুটবল খেলায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে গারিঞ্চার। এখন স্টেডিয়ামে দর্শকেরা ‘ওলে’ বলে যে সমন্বিত রব তোলেন, তার প্রথম প্রচলন গারিঞ্চার খেলায় মুগ্ধ হয়েই। ১৯৫৮ সালে বোটাফোগোর হয়ে খেলার সময় রিভার প্লেটের ডিফেন্ডার ভাইরোকে একপ্রকার ফুটবল শিখিয়েছিলন গারিঞ্চা। ভাইরোকে এমনই ঘোল খাইয়েছিলেন, দর্শকেরা আনন্দিত ও উল্লসিত হয়ে ‘ওলে’ ধ্বনি তুলতে থাকে, যেটাই পরে একপ্রকার ঐতিহ্য হয়ে যায়।
তবে এমন এক কিংবদন্তি ফুটবলারের শেষটা কিন্তু বড়ই করুণ। তাঁর বাবা ছিলেন প্রচণ্ড মাদকাসক্ত, ছেলে গারিঞ্চাও বাবার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। ১৯৬৯ সালে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে শাশুড়িকে মেরে ফেলার মত ঘটনাও ঘটিয়েছেন। জীবনের শেষভাগে এসে খুবই অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, এক ১৯৮২ সালেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে আট বার! শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে লিভার সিরোসিসের কাছে হার মানেন মাঠে কখনো হার না মানা ‘লিটল বার্ড’।
গারিঞ্চাকে সম্মান জানাতে ব্রাসিলিয়ার একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে, ‘এস্তাদিও মানে গারিঞ্চা’। কিংবদন্তি এই ফুটবলারের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে দুইটি সিনেমাও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গারিঞ্চা চিরকাল মানুষের মনে থেকে যাবেন এক ‘বাঁকানো পায়ের দেবদূত’ হিসেবেই, বল পায়ে ড্রিবলিংয়ে যার জুড়ি মেলা ভার!