বার্সেলোনার সোনালী প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন তিনি। পেপ গার্দিওলার সেই অজেয় বার্সার অন্যতম কাণ্ডারি, গার্দিওলা পরবর্তী যুগেও বার্সাকে বেঁধে রেখেছিলেন এক সুতোয়। সবুজ মাঠের নরম ঘাসে আলতো ছোঁয়ায় যেন ফুল ফোটাতেন ফুটবল মাঠের এই শিল্পী। ভালোবেসে ভক্ত সমর্থকেরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘ডন’। এই ডন অস্ত্র হাতে মানুষ মারেন না, বরং ফুটবলে পেলব ছোঁয়ায় সকলকে মোহাবিষ্ট করে রাখেন ৯০ মিনিট। কার কথা বলা হচ্ছে, বার্সা সমর্থক মাত্রই তাঁর বুঝে যাওয়ার কথা। বলা হচ্ছিল আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা, বার্সার মাঝমাঠের কাণ্ডারির কথা।
রিয়ালের মাঠে গিয়ে স্ট্যান্ডিং অভেশন পাওয়ার নজির খুব বেশি বার্সা খেলোয়াড়ের নেই। ইনিয়েস্তা সেই দুর্লভ প্রজাতির মানুষের একজন। ইনিয়েস্তা যে বার্সা-রিয়াল ছাপিয়ে পুরো স্পেনের! স্পেনের যে প্রান্তেই খেলতে যান না কেন, দর্শকদের ভালোবাসায় সিক্ত হন। দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতানো গোল দিয়ে যে স্পেনের ফুটবল ইতিহাসেই অমর হয়ে গেছেন এই কিউল!
সেই আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাই খুব সম্ভবত বার্সেলোনার জার্সি গায়ে নিজের শেষ ফাইনালটা খেলে ফেললেন। এই মৌসুম শেষেই চাইনিজ ক্লাবে যোগ দেয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সেই হিসেবে প্রিয় মেরুন জার্সিতে এটিই ছিল বার্সেলোনার শেষ ফাইনাল। কি দারুণভাবেই না সেই উপলক্ষ রাঙিয়ে রাখলেন তাঁর সতীর্থরা! অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠ ওয়ান্ডা মেট্রোপলিতানোতে কোপা ডেল রে’র ফাইনালে সেভিয়াকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে রেকর্ড ৩০ তম কাপ শিরোপা জিতেছে বার্সেলোনা, সর্বশেষ পাঁচ বছরে ফাইনালে উঠেছে দলটি, আর গত চার বছরে চার বার বার্সেলোনার ঘরেই গেল এই শিরোপা।
লুইস সুয়ারেজের জোড়া গোল, সাথে লিওনেল মেসির এক গোল ও দুই অ্যাসিস্টের সুবাদে সেভিয়াকে স্রেফ পাত্তাই দেয়নি বার্সা। ম্যাচের প্রথমার্ধেই ম্যাচের ফল নিয়ে সব জল্পনা কল্পনা শেষ করে দেয় আর্নেস্তো ভালভার্দের দল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে জঘন্য খেলে রোমার কাছে হেরে বাদ পড়লেও এদিন সেরা ফর্মে দেখা দেয় বার্সা। ম্যাচের মাত্র ১৩ মিনিটেই এগিয়ে যায় কাতালানরা। গোলকিপার ইয়াসপার সিলেসেনের ৭০ গজের লং পাস সেভিয়া ডিফেন্ডাররা ক্লিয়ার করতে না পারায় বল নিয়ে ডি বক্সে ঢুকে পড়েন ফিলিপে কৌতিনহো। তাঁর পাস থেকে ফাঁকা পোস্টে বল ঠেলে দিতে ভুল করেননি সুয়ারেজ। এই নিয়ে বার্সেলোনার হয়ে ৫ টি ফাইনাল খেলে সবকয়টিতেই গোল করলেন সুয়ারেজ।
দ্বিতীয় গোলটি ছিল অনেকটাই বার্সেলোনা সুলভ, এবং সেটির কারিগর আলবা-মেসি জুটি। এই মৌসুমে বার্সার সবচেয়ে কার্যকরী জুটি আলবা-মেসি, আর গত ১০ বছর ধরে সবচেয়ে কার্যকরী জুটিগুলোর একটি ইনিয়েস্তা-মেসি জুটি। বার্সার দ্বিতীয় গোলে অবদান থাকলো এই তিনজনেরই। মেসি-ইনিয়েস্তা-আলবা-ইনিয়েস্তা-আলবা হয়ে বল চলে যায় বক্সে নিজের মুভমেন্ট দিয়ে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে নেয়া মেসির কাছে। আলবার নো লুক পাস থেকে নিখুঁত শটে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে ৩১ মিনিটেই দলকে ২-০ তে এগিয়ে নেন মেসি। এই নিয়ে কোন ফাইনালে ২৮ টি গোল হল বার্সার। সংখ্যাটি আর বাড়েনি এদিন, কিন্তু বার্সার পরের দুইটি গোলের কারিগরও এই ক্ষুদে জাদুকর।
ইনিয়েস্তা, বুসকেটস, মেসিরা মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবেই। সেভিয়াকে যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না মাঠে। এরই মধ্যে প্রথমার্ধে পাওয়া নিজেদের সেরা সুযোগটা মিস করেন ফ্রাঙ্কো ভাজকুয়েজ, সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও বল মারেন সিলেসেনের হাতে।
বিরতিতে যাওয়ার পাঁচ মিনিট আগে নিজেদের শিরোপা জেতা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে বার্সেলোনা। মাঝ মাঠ থেকে মেসির নিখুঁত পাসে পাক্কা গোলস্কোরারের মতো বল জালে ঠেলে দিয়ে ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় গোল পেয়ে যান সুয়ারেজ।
বার্সার হয়ে নিজের শেষ ফাইনালে বোধ হয় একটি গোল করতে চাইছিলেন ইনিয়েস্তাও। সতীর্থের মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরেই কিনা, সেই ইচ্ছা পূরণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন মেসিই। ৫২ মিনিটে ইনিয়েস্তার সাথে ওয়ান টু খেলে বক্সে দারুণ এক পাস দিলেন ইনিয়েস্তাকে। সেভিয়া কিপার সরিনকে ডান পায়ের শটে পরাস্ত করতেই সতীর্থদের আলিঙ্গনে বাধা পড়েন বর্ষীয়ান এই ফুটবলার।
আর গোল উৎসবের শেষটা হলো প্রথম গোলের কারিগর ফিলিপে কৌতিনহোকে দিয়ে। নেইমার থাকার সময় অনেকবারই দেখা গেছে, কোন ম্যাচে মেসি-সুয়ারেজ গোল পেয়েছেন কিন্তু নেইমার পাননি, তখন নেইমারকে দিয়ে গোল করাতে উঠে পড়ে লাগতেন দুজনে। কৌতিনহোর বেলায়ও যেন তাই করলেন মেসি। ৬৯ মিনিটে হ্যান্ডবলের সুবাদে পেনাল্টি পায় বার্সা। চাইলেই পেনাল্টি থেকে গোল করে মোহামেদ সালাহর সাথে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জয়ের লড়াইয়ে আরও কাছাকাছি চলে আসতে পারতেন। কিন্তু মেসির কাছে এসব ব্যক্তিগত পুরষ্কার কবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল! কৌতিনহোকেই নিতে দিলেন পেনাল্টি, গোল করে দলের জয়টাও নিশ্চিত করেছেন এই ব্রাজিলিয়ান।
ম্যাচের তিন মিনিট বাকি থাকতে যখন মাঠ ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন ইনিয়েস্তা, পুরো মাঠের দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন এই স্পেন কিংবদন্তিকে। আবেগঘন হয়ে পড়েছিলেন ইনিয়েস্তাও। শৈশবের ক্লাবের হয়ে শেষবারের মতো ফাইনাল খেলে ফেললেন, এটি জেনেই কিনা চোখ ছলছল করে উঠলো তাঁরও। পরে বার্সার শিরোপা উৎসবের মধ্যমণিও ছিলেন তিনিই।
বার্সার মূল দলে অভিষেকের ১৬ বছরের মাথায় এটি ইনিয়েস্তার ৩৪ তম শিরোপা। ৩৫ তম শিরোপা জয়ের থেকেও দাঁড়িয়ে আছেন নিঃশ্বাস দূরত্বে। রিয়াল বেটিসের সাথে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ড্র করায় আর এক পয়েন্ট পেলেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন হবে বার্সা, ইনিয়েস্তা জিতবেন আরেকটি ডাবল।