সেই ১৯৯৬ সালে যখন এসেছিলেন, আর্সেন ওয়েঙ্গারকে ফুটবল বিশ্বে তখনো খুব কম বোদ্ধাই চেনেন। ফ্রেঞ্চ লীগে মোনাকোকে শিরোপা জিতিয়ে ও জাপানের এক ক্লাবকে ১৮ মাস কোচিং করিয়ে যখন লন্ডনের ক্লাবটিতে এলেন এই ফ্রেঞ্চ ম্যান, ভ্রু কুঁচকেছিলেন অনেকেই। এরপর ‘অপরিচিত’ সেই ফরাসি লোকটিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন আর্সেনাল নামটির সমার্থক। প্রিমিয়ার লীগে বহু কোচ এসেছেন গেছেন, কিন্তু আর্সেনালে আর্সেন ওয়েঙ্গারের বিকল্প কেউ আসেননি। অবশেষে সুদীর্ঘ ২২ বছর পরে আর্সেনালের সাথে মধুর এই সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন ওয়েঙ্গার। আরও এক বছর চুক্তির মেয়াদ থাকলেও এই মৌসুমে দলের বাজে পারফরম্যান্সের দায় নিয়ে এই মৌসুম শেষেই আর্সেনালের ডাগআউট থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জেতাতে না পারলেও ওয়েঙ্গারের সাথে জুড়ে ছিল আর্সেনালের বহু আবেগ। শুধু আর্সেনাল নয়, আর্সেন ওয়েঙ্গারকে মনে রাখবে গোটা প্রিমিয়ার লীগই। তেমনি পাঁচটি কারণ নিয়ে আজকের আয়োজন।
১) ওয়েঙ্গারের ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ আর্সেনাল
আর্সেনাল ও আর্সেন ওয়েঙ্গার নাম দুইটি বললেই ফুটবলপ্রেমীদের মাথায় সবার আগে আসে ২০০৩-০৪ মৌসুমের প্রিমিয়ার লীগ। ৩৮ ম্যাচের লীগে সম্পূর্ণ অপরাজিত থেকে শিরোপা জেতার নজির যে সেবারই প্রথম ও শেষবার দেখেছিল প্রিমিয়ার লীগ! পুরো মৌসুমে হারেননি একটি লীগ ম্যাচও, দলকে করেছিলেন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
শুধু লীগের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই মৌসুমে মোট ৪৯ ম্যাচে অপরাজিত ছিল ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল। ২০০৩ এর মে থেকে ২০০৪ এর অক্টোবর, প্রায় দেড় বছর আর্সেনালকে হারাতে পারেনি! এর আগে ১৯৭৭ এর নভেম্বর থেকে ১৯৭৮ এর নভেম্বর পর্যন্ত টানা ৪২ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড ছিল নটিংহাম ফরেস্টের। ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া আর্সেনালের এই অপরাজিত থাকার যাত্রা শেষ হয় ওল্ড ট্রাফোর্ডে বিতর্কিত এক পেনাল্টিতে ২-০ গোলে হেরে।
২০০৩-০৪ এ পুরো লীগ জুড়ে মাত্র চারটি ম্যাচে গোল করতে পারেনি আর্সেনাল, গোলশূন্য ড্র করে বার্মিংহাম, নিউক্যাসল, ফুলহাম ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। অপরাজিত থাকা ৪৯ ম্যাচের মধ্যে জিতেছে ৩৬ টিতে, আর বাকি ১৩ টি ড্র। ১১২ টি গোল করার বিপরীতে খেয়েছে মাত্র ৩৫ টি। ঘরের মাঠে ২৫ ম্যাচ খেলে জিতেছেন ২০ টিতে, আর প্রতিপক্ষের মাঠে ২৪ ম্যাচে জয় ১৬ টিতে।
আর এই ৪৯ ম্যাচের অপরাজিত যাত্রায় আর্সেনালের ডিফেন্সের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দুই স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরি ও রবার্ট পিরেসের। অঁরি করেছিলেন ৩৯ গোল, আর পিরেস ২৩ গোল। অপরাজিত থেকে লীগ জেতার এই এক কীর্তি দিয়েই আজীবন প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন ওয়েঙ্গার।
২) ডাবলের ডাবল:
১৯৯৬ সালে লন্ডনের ক্লাবটিতে এলেও আর্সেনালে ওয়েঙ্গারের প্রথম পূর্ণ মৌসুম ছিল ১৯৯৭-৯৮ মৌসুম। আর নিজের প্রথম পূর্ণ মৌসুমেই বাজিমাত করেন ওয়েঙ্গার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আধিপত্য ভেঙে আর্সেনালকে জেতান প্রিমিয়ার লীগ, আর নিউক্যাসলকে হারিয়ে জেতেন এফএ কাপ।
শুধু একবার নয়, এই কীর্তির পুনরাবৃত্তিও করেছেন আরকবার। ২০০২ মৌসুমে আবারো লীগ-কাপের ডাবল। এবার কাপের ফাইনালে হারান চেলসিকে, ২-০ গোলে।
৩) সান সিরোতে ইন্টারের বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয়:
ইংলিশ ফুটবলে বেস রাজত্ব করছিল ঠিকই, কিন্তু ইন্টারের মাঠে গিয়ে ইন্টারকেই ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত করবে আর্সেনাল, এমনটা ভাবতে পারেননি কেউই। ২০০৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ম্যাচে আর্সেন ওয়েঙ্গারের দলের এমন দাপুটে জয়ে বিস্মিত হয়েছিল গোটা ইউরোপ। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেরা পারফরম্যান্সের তালিকাতেও অনেকে রাখেন এই ম্যাচকে। ম্যাচে অঁরি করেছিলেন জোড়া গোল।
৪) এমিরেটসে স্থানান্তর:
আর্সেনালের আজকের আর্সেনাল হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম বড় প্রভাবক ছিল হাইবুরি ছেড়ে ৬০ হাজার আসন বিশিষ্ট বিশ্বমানের স্টেডিয়াম এমিরেটসে স্থানান্তরিত হওয়া। চেলসি ও স্পার্সদের ছাড়িয়ে লন্ডনের সবচেয়ে দামী ক্লাব হওয়ার পেছনেও অবদান আছে এই স্টেডিয়ামের। ওয়েঙ্গারই দলকে এই নতুন স্টেডিয়ামে নিয়ে আসেন। আর্সেনালে তাঁর অবদান হিসেবে এটিকেও মনে রাখবেন গানার ফ্যানরা।
৫) পরপর দুই বছর এফএ কাপের শিরোপা জয়:
প্রিমিয়ার লীগ না জেতার আক্ষেপটা বোধহয় ওয়েঙ্গার মেটাতে চেয়েছেন এফএ কাপ জিতেই। ক্যারিয়ারে মোট ৭ বার এফএ কাপ জেতা ওয়েঙ্গার পরপর দুইবার জিতেছেন ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। এই জয় আর্সেনাল ভক্তদের কাছে আরও বিশেষ কিছু, কারণ নয়টি দীর্ঘ বছর ট্রফিলেস থাকার পরে স্বস্তির সুবাতাস হয়ে এসেছিল পরপর দুই বছরের এই দুইটি ট্রফি। আর্সেন ওয়েঙ্গারের মানসিক দৃঢ়তার পরিচয়ও যেন দেয় এই ট্রফি দুইটি। দীর্ঘদিন কোন বড় শিরোপা জিততে না পারলেও ভেঙে পড়েননি তিনি, ঠিকই ক্লাবকে ফিরিয়েছেন জয়ের ধারায়।