মাস দুয়েক পরেই রাশিয়ায় বসতে যাচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপের ২১ তম আসর। সেই ১৯৩০ সালের প্রথম আসর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপেই ব্যবহৃত হয়েছে আলাদা আলাদা বল। ফুটবল ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাওয়া সেই বলগুলো নিয়েই আমাদের প্রিয়লেখার ধারাবাহিক আয়োজন। আজ শেষ পর্বে থাকছে সর্বশেষ সাতটি আসরের বলের গল্প। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ।
কেস্ট্রা; ১৯৯৪ বিশ্বকাপ
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। এই বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস বল হিসেবে নির্বাচন করে কেস্ট্রাকে। এই বলের থিম হিসেবে বাছাই করা হয় মহাশূন্য ভ্রমণ। বলের ডিজাইনে এটি স্পষ্ট। বলটিকে বিশ্বকাপের সবচেয়ে হাই পারফরমেন্স মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্য ছিল অ্যাডিডাসের।
ইতালিতে একটি ম্যাড়মেড়ে টুর্নামেন্টের পর ফিফা চাইছিল নতুন কিছু করতে। এই বলের নতুন সংযোজন হলো, বলের উপরে পলিস্টিরিনের একটি স্তর যুক্ত করা হয়। বলা হয়, বলকে আরও নরম করতে, বল নিয়ন্ত্রণে খেলোয়াড়দের আরও সুবিধা করে দিতে ও খেলার গতি বাড়াতেই এই নতুন সংযোজন।
ফলও মিলেছিল এই আয়োজনের। কোয়ার্টার ফাইনালে একটি দলও ক্লীন শীট রাখতে সমর্থ হয়নি। প্রথম নকআউট রাউন্ডে ষোল দলের মধ্যে কেবল তিনটিই পেরেছিল গোল না খেয়ে ম্যাচ শেষ করতে। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র তিনটি ম্যাচ গোলশূন্য হয়েছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই তিনটি ম্যাচের একটি ছিল ফাইনাল ম্যাচই। কিন্তু তারপরেও এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম গোলস্কোরিং টুর্নামেন্ট, ১৯৮২ টুর্নামেন্টের পরে সর্বোচ্চ। দুর্দান্ত কিছু গোলও দেখেছে এই বিশ্বকাপ।
ট্রাইকালার; ১৯৯৮ বিশ্বকাপ
রঙিন টেলিভিশনে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ১৯৭০ সালে দেখা গেলেও রঙিন বলের আবির্ভাব ১৯৯৮ বিশ্বকাপে।
ফ্রান্স ১৯৯৮ বিশ্বকাপের জন্য অ্যাডিডাস প্রবর্তন করে অ্যাডিডাস ট্রাইকালার বলের। বহু রঙ বিশিষ্ট প্রথম বিশ্বকাপ বল এটি। ডিজাইন অনেকটা ট্যাঙ্গোর মতই, কিন্তু রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয় লাল, নীল ও সাদা রঙ। ফ্রান্সের জাতীয় পতাকার সাথে মিল রেখে এই তিন রঙ বাছাই করা হয়।
এই বলে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও যথেষ্ট ভালো হয়। আগের বিশ্বকাপের সেই পলিস্টিরিনের স্তর এই বিশ্বকাপের বলেও অব্যাহত থাকে, ফলে খেলার গতি ও বলের মান দুটোই বৃদ্ধি পায়। তবে সব ছাপিয়ে এই বলের মূল বৈশিষ্ট্য সেই বহু রঙয়ের ব্যবহারই।
ফিভারনোভা; ২০০২ বিশ্বকাপ
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে অনুষ্ঠিত ২০০২ বিশ্বকাপ দিয়েই বিশ্বকাপের বল নিয়ে অ্যাডিডাস তাদের ব্যাপক মাত্রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করে।
প্রথম পরিবর্তনটা আসে বলের ডিজাইনে। এতদিন ধরে চলে আসা ট্যাঙ্গো বলের ডিজাইন থেকে বেরিয়ে এসে আরও বড় ক্যানভাসে সবুজ, সোনালী ও লাল তিন কোণা প্যাটার্ন বিশিষ্ট ব্ল্যাঙ্ক ডিজাইন করা হয়।
ডিজাইন ছাড়া বলের কারিগরি দিকেও পরিবর্তন আনে অ্যাডিডাস। অনেক খেলোয়াড়েরাই বলেছেন, আগের অনেক বলের তুলনায় এই বল খেলার জন্য অনেক বেশি সুবিধাজনক ও আরামদায়ক। তবে এই বলের ওজন নিয়ে কিছুটা বিতর্ক হয়েছিল, ফিফা কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল এই বলের ওজন।
অ্যাডিডাসের অ্যাম্বাসেডর ডেভিড বেকহাম আয়োজকদের দাবির সাথে সহমত জানিয়ে বলেছিলেন, আগের অন্য যেকোনো বলের তুলনায় এই বলের ফিচার অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। তবে ভিন্নমতও আছে। ইতালিয়ান গোলকিপার জিয়ানলুইজি বুফন এই বলকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ক্রেজি বাউন্সিং বল’ বলে।
টিমজিস্ট; ২০০৬ বিশ্বকাপ
টিমজিস্ট মানে টিম স্পিরিট। স্বাগতিক জার্মানির ঐতিহ্যবাহী রীতি দলীয় সংহতির প্রতি সম্মান জানাতেই বলের এমন নামকরণ।
এই বলে প্যানেল রাখা হয় ১৪ টি, বলকে আরও গোলাকার আকার দেয়ার জন্যেই এমন সিদ্ধান্ত। রিলিজের পরপরই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এই বল। কিন্তু এই বলেরও সমালোচনা ছিল। কিছু খেলোয়াড়ের অভিযোগ, বাতাসে ভেসে থাকাকালীন এই বলের ফ্লাইট বোঝা খুবই কঠিন। খেলোয়াড়েরা ফ্লাইট বুঝতে বিভ্রান্ত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই বুঝতে পারা গিয়েছিল এটি। কোস্টারিকার খেলোয়াড়েরা জার্মানির বাড়ানো লং বলগুলো ধরতে বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন, যেই সুযোগ গোল করেছিলেন ফিলিপ লাম ও টরস্টেন ফ্রিংস।
বার্লিনের ফাইনালের জন্য বিশেষ সোনালী বল তৈরি করেছিল অ্যাডিডাস, নাম দিয়েছিল টিমজিস্ট বার্লিন।
জাবুলানি; ২০১০ বিশ্বকাপ
এখনো পর্যন্ত যত বল তৈরি হয়েছে, তাদের সবাইকেই আলোচনার দিক থেকে টেক্কা দিয়েছে ২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপের বল জাবুলানি। বলকে আরও গোলাকার বানানোর উদ্দেশ্যে ১৪ প্যানেল থেকে কমিয়ে এই বলে প্যানেল রাখা হয় মাত্র ৮ টি।
এই বলটি আগের বারের বলের চেয়েও বেশি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল বলে অভিযোগ অনেকের, বিশেষ করে গোলকিপারদের। বলের ফ্লাইট বুঝে লাফ দিয়ে বল ধরতে অনেকেরই সমস্যা হচ্ছিল। ব্রাজিলের জুলিও সিজার এই বলকে তুলনা করেন সুপারমার্কেটে বিক্রি হওয়া সস্তা বলের সাথে। স্পেনের ইকার ক্যাসিয়াস এই বলকে ‘বিভীষিকা’ বলে আখ্যা দেন। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে অ্যাডিডাস দাবি করে, ছয় মাস নিবিড় পর্যবেক্ষণের পরেই এই বল বাছাই করা হয়েছে। ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড ও মাইকেল বালাকের মতো অ্যাডিডাস সমর্থিত খেলোয়াড়েরা অবশ্য অনুমিতভাবে বলের প্রশংসাই করেন।
শেষ পর্যন্ত এই বিতর্ক সমাধানে এগিয়ে আসতে হয় নাসাকে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারা জানায়, আগের অন্য যেকোনো বলের তুলনায় জাবুলানি বাতাসে মুভ করে অনেক বেশি গতিতে, কারণ এর উপরিভাগ অনেক বেশি মসৃণ। আর এই বাতাসে বেশি গতিতে মুভ করার কারণেই ফ্রি কিক ও লং বলগুলো আটকাতে অসুবিধা হচ্ছিল গোলকিপারদের।
ব্রাজুকা; ২০১৪ বিশ্বকাপ
জাবুলানি নিয়ে অ্যাডিডাসের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না, ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের জন্য তাই প্রস্তুতিতে কোন ঘাটতি রাখতে চায়নি তারা। অ্যাডিডাসের দাবি অনুযায়ী, ব্রাজুকার জন্য যত পরীক্ষা নিরীক্ষা তারা করেছে, অন্য কোন বলের জন্যই এতটা করা হয়নি।
ফিফার ভাষ্যমতে, ব্রাজুকা শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, ‘ব্রাজিলিয়ান জীবন ধারণ ব্যবস্থার উপর জাতীয় গর্ব’। বলে একাধিক রঙয়ের রিবন ব্যবহার করা হয়। এই বলের প্যানেল সংখ্যা জাবুলানির চেয়েও কমিয়ে এনে ৬ এ নামানো হয়। বিশ্বকাপের আগেই পরীক্ষা করার জন্য অনেক দল ও খেলোয়াড়ের কাছে এই বল পাঠায় অ্যাডিডাস কোম্পানি। এমনকি কোন কোন লীগেও ছদ্মবেশে পাঠানো হয় এই বল। পরবর্তীতে বুন্দেসলিগা ও এমএলএস এ এই বল দিয়ে খেলানো হয়।
টেলস্টার ১৮; ২০১৮ বিশ্বকাপ
গত বিশ্বকাপের নভেম্বরে রাশিয়া বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক বল টেলস্টার ১৮ রিলিজ করে অ্যাডিডাস। এই বল অনেকটা ১৯৭০ টেলস্টার বলেরই অনুকরণ, ১৯৯৪ সালের পর এই প্রথম বল আবার সাদা কালোতে ফিরছে রাশিয়ায়। এই বলে রঙ বলতে একমাত্র সোনালী অ্যাডিডাস লোগো, টেলস্টার ও বিশ্বকাপের লোগোর রঙ। ব্রাজুকার মতো এই বলেও প্যানেল সংখ্যা ছয়টি।