ইতিহাসের পাতায় যেমন রয়েছে হাজারো বর্ণালী অতীত, ঠিক তেমনি রয়েছে বীভৎস কিছু গাঁথা। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার মতো কাজ করছেন কেউ কেউ, সিংহাসনের লোভে হত্যা করেছেন নিজেদের পিতা মাতা কিংবা ভাইকে। আচ্ছা, যদি আপনাদের প্রশ্ন করি, আপনার জানা ইতিহাসের সেরা হত্যাকারী কে? মাথা চুলকে কার কথা ভাববেন? হিটলার নাকি অন্য কেউ? যদি বলি তিনি একজন নারী? হত্যাকারী হিসেবে নারীর কথা শুনতেই আমরা অনেকে নড়েচড়ে বসি কারণ, নারীকে সচরাচর আমরা কোমল এবং সৃষ্টির কারিগর হিসেবেই জানি। প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন একজন নারী। সে নারীর হাতেই যখন উঠে আসে অত্যাচারের খড়গ, তাহলে কেমন হয়? আসুন আজ জেনে নিই ইতিহাসের এমনই এক অত্যাচারীর কথা।
অনেকেই বলেন যে কাউন্টেস এলিজাবেথ ব্যাথোরি পৃথিবীর জঘন্যতম সিরিয়াল কিলারদের মাঝে একজন এবং ব্রাম স্টোকার যখন ড্রাকুলা বইটি লিখতে শুরু করেন, তখন ব্যাথোরিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী প্রায় ৬৫০ যুবতীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে তার হাত। এরা সবাই তার মেইড (সাহায্যকারী) ছিল। নির্মম অত্যাচার এবং না খাইয়ে এদের মেরে ফেলেন তিনি। অনেকে বলেন, প্রতিটা হত্যা করবার পর তাদের রক্তে নিজেকে গোসল করাতেন ব্যাথোরি। গ্রামবাসীরা নাকি নিজেদের মেয়েদের রাতের বেলা ঘরে আটকে রাখতেন এই ভেবে যে ব্যাথোরি হয়ত মেয়েদের চুরি করে হত্যা করতে পারে। ইতিহাসের পাতায় ব্যাথোরি ‘দ্য ইনফেমাস লেডি’, ‘দ্য ব্লাড কাউন্টেস’ ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত।
এলিজাবেথ ব্যাথোরি আনুমানিক ১৫৬০ সালে হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তখনকার সময় এলিজাবেথের পরিবার হাঙ্গেরির অন্যতম শক্তিশালী প্রটেস্ট্যান্ট প্রবার ছিল। তার পিতার নাম ব্যারন জর্জ ব্যাথোরি এবং মাতার নাম ব্যারনেস অ্যানা ব্যাথোরি। জন্মের পর থেকেই নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হন এলিজাবেথ। মৃগীরোগ, উচ্চস্বরে কথা বলা, নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং প্রচণ্ড রাগ। অনেকে বলেন হত্যা করার প্রবণতা এলিজাবেথ তার পরিবার থেকেই পেয়েছে। বাবার অধস্থন কর্মচারীদের প্রতি নির্মম ব্যবহার ও শাস্তি তাকে করে তুলেছিল আরও নির্দয় ও পাষণ্ড। এলিজাবেথ নিজেও ছেলেবেলায় মানুষের সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করত। একবার এক বৃদ্ধার ওপর চুরির অভিযোগ আসবার কারণে হতভাগা মহিলার পেট ফেড়ে দিয়ে একটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয়। সমগ্র রাস্তায় ছিটকাতে থাকে মহিলার নাড়িভুঁড়ি ও রক্ত। সে দৃশ্য দেখে নাকি এলিজাবেথ পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছিলেন, দিয়েছিলেন হাততালি। শয়তানের পূজা এবং আত্মপীড়নের মাধ্যমে যৌনতৃপ্তি লাভ ইত্যাদি নানাধরনের বিকৃত আচারের সাথে জড়িত ছিলেন এলিজাবেথ। পরিবারের চাচা চাচীর নিকট এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড শিখেছিলেন এলিজাবেথ।
১৫ বছর বয়সে এলিজাবেথের বিয়ে হয় কাউন্ট ফেরেনক নাখদাসদির সাথে। ফেরেনক তখন হাঙ্গেরির প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করা অটোমান অপশক্তির বিরুদ্ধে ধেয়ে যাচ্ছিলেন। বিয়ের পর নাখদাসদি স্টেটের কাউন্টেস বনে যান এলিজাবেথ। তার স্বামীও ছিল প্রজাদের প্রতি প্রচণ্ড নির্মম। ফেরেনক তার স্ত্রীকে অত্যাচার করবার কিছু কৌশল হাতে ধরে শিখিয়ে দেন। এই দম্পতির ঘরে তিনটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। স্ত্রীর নির্যাতনের সাথে স্বামীও যোগদান করতেন তবে ১৬০০ সালের দিকে স্বামীর মৃত্যুর পরই এলিজাবেথের আসল চরিত্র বেরিয়ে আসে। কাউন্টের মৃত্যুর পর তিনি স্লোভাকিয়ার দিকে চলে যান এবং একটি দূর্গ তৈরি করেন। তার চারপাশে এমন সব সহচর দিয়ে ঘেরা ছিল যারা বিভিন্ন সময় নির্যাতনে সাহায্য করতেন রানীকে। কিংবদন্তীতে আছে, একদিন এক মেইড চুল আঁচড়াতে গিয়ে রানীর চুল চিরুনি দিয়ে এমন জোরে টান দেয় যে তিনি খুব ব্যথা পান। ক্রোধান্বিত হয়ে মেয়েটিকে হাতের কনুই দিয়ে আঘাত করেন। আঘাতটি এতই জোরে ছিল যে প্রচণ্ড রক্তপাতে মেয়েটি মারা যায়। তার মুখের কিছু রক্ত হাতে ছিটকে এসে পড়ে রানীর। রাতের বেলা ঘুমাতে এসে তিনি দেখলেন যে মেয়েটির রক্ত যে হাতে এসে পড়েছে, তার কিছু জায়গা এমন চকচকে হয়ে আছে যে সেখানে যেন নতুন চামড়া গজিয়েছে। রানী উল্লসিত হয়ে ভাবলেন সামান্য এতটুকু রক্ত যদি এতটা পরিবর্তন করতে পারে চামড়ায়, তাহলে না জানি সমগ্র শরীরে রক্তস্নান করলে কতটা পরিবর্তন আসবে! এই ভাবনায় আরও রক্তপিপাসু হয়ে উঠলেন এলিজাবেথ। নির্মমভাবে হত্যা করতে শুরু করলেন তার মেইডদের, তাদের রক্তে করতে লাগলেন স্নান।
এমন করেই আস্তে আস্তে এলিজাবেথের গ্রাম থেকে উধাও হতে লাগল কুমারী, বিবাহযোগ্য কন্যা এবং কমতে লাগল প্রাসাদ থেকে মেইড। ভয়ংকর রক্তপিপাসু হয়ে উঠলেন রানী। কারারুদ্ধ করতে লাগলেন হতভাগ্য মেয়েদের। তাদের রক্তে করতে লাগলেন স্নান। নবযৌবন পাবার আশায় হয়ে উঠতে লাগলেন ভয়ানক এক সিরিয়াল কিলার।
১৬০৯ সালের দিকে এক কুমারীকে হত্যা করবার পর নড়েচড়ে ওঠে প্রশাসন। তার প্রাসাদে হানা দেয় পুলিশ। এলিজাবেথ চেয়েছিল মেয়েটিকে নিয়ে একটি আত্মহত্যার ঘটনা সাজাতে কিন্তু পুলিশের তৎপরতায় সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তারা দূর্গে হানা দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। যেন একটি গণহত্যা চালানো হয়েছে সেখানে। এখানে সেখানে পড়েছিল হতভাগ্য মেয়েদের লাশ। বিচারে এলিজাবেথকে আজীবন একটি কক্ষে কারারুদ্ধ করে রাখা হয় এবং সেখানে অল্প কিছু খাবার ও পানি দেয়া হতো তাকে। সাথের সহচরদের হত্যার আদেশ দেয়া হয়। ছোট এই ঘরে প্রায় সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন ইতিহাসের কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলার।
ইতিহাসের পাতায় যত কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার রয়েছে, তাদের মাঝে এলিজাবেথ ব্যাথোরি তাদের মাঝে অন্যতম। মূলত তার হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় একটি কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে।