এবারের আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর প্রথম ম্যাচ চলছে। স্পট ইন্টারভিউয়ের এক পর্যায়ে ধারাভাষ্যকার সাইমন ডুল এবিডি ভিলিয়ার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুলওয়ান্ত খেজরোলিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন আমাদের।’ ডি ভিলিয়ার্সের সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি আসলে খুব বেশি জানি না এখনো।’
ডি ভিলিয়ার্স একাই নন। কুলওয়ান্ত খেজরোলিয়াকে চেনেন না এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। না চেনাটা দোষের কিছুও নয়। এমনকি আরসিবিতে তার নিজের সতীর্থরাই তাকে এখনো ঠিকভাবে চেনেন না। মুদি দোকানে কাজ করা, টেবিল পরিষ্কার করা, খাবার অর্ডার নেয়া ও ডেলিভারি দেয়া রাজস্থানের এক ছোট্ট গ্রাম ঝুনজুনুর ছেলে খেজরোলিয়াকে এখন অনেকেই চিনবেন। গ্রাম থেকে আসা এই ছেলেটি যে এবার খেলছেন তারকাখচিত দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুতে!
ঠিকভাবে লাল বলে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলাই শুরু করেছেন ২০১৬ সালের দিকে। ক্রিকেট খেলার জন্য চলে এসেছিলেন দিল্লীতে। গল্পটা শুনুন তার মুখেই, ‘আমি তখন গোয়াতে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করি। একদিন ভাবলাম, আমার ভাগ্যে যদি এটা লেখা থাকে, তাহলে এটা পাঁচ বছর পরেও করতে পারব আমি। আমি খুব করে ক্রিকেট খেলতে চাইছিলাম। আমি বাবা মা কে বললাম আমি আহমেদাবাদ যাচ্ছি রোডওয়েজ ডিপার্টমেন্টে যোগ দিতে। ছয় মাস তাদের থেকে সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম কোনরকমে। শুধু আমার ভাই ই জানতো আসল ঘটনা।’
খরচ বাঁচানোর জন্য শহরের একটু বাইরে অশোক বিহারে আরও ছয়জনের সাথে একটি ফ্ল্যাটে উঠলেন। তার এক রুমমেটের রোহিনীতে জাপানিজে পার্কে ক্রিকেট খেলে এমন একজনের সাথে কিছুটা পরিচয় ছিল। একদিন কুলওয়ান্তকে সাথে করে নিয়ে গেলেন ওই ক্লাবে। নিজের বোলিং দিয়ে মুগ্ধ করলেন ক্লাব কর্মকর্তাদের, তাকে দলের নিয়মিত সদস্য করে নিলেন তারা। প্রতি ম্যাচ খেলার জন্য খেজরোলিয়াকে ৫০০ করে টাকা দিত ক্লাব। একদিন সপ্তাহান্তের এক ম্যাচে সঞ্জয় ভরদ্বাজের সাথে পরিচয় হলো তার।
দিল্লীর ক্রিকেট মহলে পরিচিত মুখ এই সঞ্জয় ভরদ্বাজ। গৌতম গম্ভীর, উন্মুক্ত চাঁদ ও এই আইপিএলে কলকাতার হয়ে খেলা নিতীশ রানার মেন্টর হিসেবে কাজ করেছেন ভরদ্বাজ। দিল্লীর শিক্ষা বিভাগের সহায়তায় অনেক উঠতি প্রতিভাকে তিনি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছেন। কিন্তু খেজরোলিয়ার মধ্যে কি এমন দেখেছিলেন ভরদ্বাজ?
‘আমি সঞ্জয় স্যারকে বলেছিলাম আপনি যা বলবেন আমি তাই করে দেখাতে প্রস্তুত আছি। তাকে বললাম আমি বাসায় মিথ্যে বলে এখানে ক্রিকেট খেলতে এসেছি। আমি এতটাই সিরিয়াস ছিলাম। তিনি আমাকে নেটে নিয়মিত বল করতে দেখেছেন। আমি একটা ট্রেনিং সেশনও মিস দেইনি। একদিন তিনি আমাকে বললেন কয়েকজন রাজ্য ক্রিকেটারকে বল করতে। যখন তিনি নিশ্চিত হলেন আমার মধ্যে কিছু একটা আছে, তখন তিনি আমার ওয়ার্কআউট ও ডায়েটের দায়িত্ব নিতে চাইলেন। তিনি আমাকে তখন আশ্রয় দিয়েছিলেন, যখন আমাকে কেউই চিনতো না।’
খেজরোলিয়ার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। শুধু ভরদ্বাজই নয়, তাকে খেয়াল করেছেন দিল্লীর নির্বাচকেরাও। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবরে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হলো তার। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে দিল্লীকে চ্যাম্পিয়ন করার পথে খেজরোলিয়ার বোলিং নজরে পড়ে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের স্কাউটদের। টুর্নামেন্টে ১০ ম্যাচে ৬.৫৬ ইকোনমিতে নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট, ফাইনালে রাজস্থানের বিপক্ষে ২৪ রানে ২ উইকেট নিয়ে জিতিয়েছিলেন দিল্লীকে। এই পারফরম্যান্সে খুশি হয়ে জানুয়ারিতে ৮৫ লাখ ভারতীয় রুপী দিয়ে তাকে কিনে নেয় দলটি।
‘আইপিএলের নিলাম যখন চলছিল তখন আমি দিল্লী যাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছার খানিক পরেই জানতে পারলাম, আমাকে নিলামে কেনা হয়েছে। আমার জন্য কেউ বিড করেছে এতেই আমি খুশি হয়েছিলাম। দেখুন তিন বছর আগেও আমি কেউ ছিলাম না। টেনিস বল ম্যাচ খেলে ৫০০ রুপী করে পেতাম। হঠাৎ করেই কেউ আমাকে লাখ লাখ রুপী দিয়ে কিনে নিয়েছে এটা শুনে প্রথমে একটু ধাক্কাই খেয়েছিলাম, কিন্তু খুশিও হয়েছিলাম।’
‘গত বছরেও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স আমাকে কিনেছিল ১০ লাখে, কিন্তু কোন ম্যাচ খেলা হয়নি। এবার আমি আত্মবিশ্বাসী যে ম্যাচ পাব, কারণ মানসিকভাবে এখন আমি অনেক বেশি পরিণত। এখন অনেক দায়িত্বশীলও হয়েছি।’
আত্মবিশ্বাস শুধু ঘরোয়া টি-২০ খেলেই আসেনি, রঞ্জি ট্রফি খেলেও এসেছে। সেমিফাইনালে পুনের সবুজ উইকেটে তৃতীয় দিন তার এক স্পেলেই বাংলা গুঁড়িয়ে যায় মাত্র ৮৬ রানে। ম্যাচে মোট ৬ উইকেট নিয়েছিলেন খেজরোলিয়া, তার পারফরম্যান্সে ভর করেই সাত মৌসুম পরে রঞ্জির ফাইনালে উঠেছিল দিল্লী।
যেই কঠিন দিন পার করে এসেছেন, সেটিই তাকে মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, ‘আমার বোনের বিয়ের জন্য আমাদের টাকা ধার করতে হয়েছিল। এমনকি সেটাও যথেষ্ট ছিল না। আত্মীয় স্বজনদের থেকে টাকা ধার করতে হয়েছিল আমার বাবাকে। আমি দেখেছি কতটা কষ্ট হতো সেই টাকা ফেরত দিতে। ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও চালাতে হতো, সব মিলিয়ে খুবই কঠিন অবস্থা ছিল আমাদের।’
‘ক্রিকেট খেলে যখনই কিছু উপার্জন করা শুরু করলাম, সবার আগে ধার ফেরত দিতে লাগলাম। আমার বাবা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না যে আমি এতদূর এসেছি, কারণ উনি মনে করতেন আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তখনই আমার ধারণা বদলে গেল। জীবনটাকে অন্যরকমভাবে দেখতে শুরু করলাম আমি।’
খেজরোলিয়ার পরিবার তাদের ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে এখন খুশি। ছেলের সাহায্যে বাবাও ব্যবসা বড় করেছে আরও। তার ভাই এখন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বোনও সুখে শান্তিতে সংসার করছে।
মানুষের জীবন কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যায়! কুলওয়ান্ত খেজরোলিয়ার চেয়ে ভালো এটি এখন আর কে ই বা বুঝবেন!