কি বলবেন একে, অবিশ্বাস্য? রূপকথার গল্প? লেখাটা পড়ার পর তা আপনি বলতেই পারেন। এ যে কল্পকাহিনীকেও হার মানানো বাস্তব জীবনের এক অবিশ্বাস্য কাহিনী! এ কাহিনী এক বাবার নিরলস, অক্লান্ত চেষ্টার কাহিনী, তাঁর অপরিসীম ধৈর্যের কাহিনী, সন্তানের প্রতি বাবার অপার ভালবাসার কাহিনী।
১৯৯৪ সালের কথা। ওয়াং মিংকিং আর লিউ ডেঙ্গিং দম্পতি চীনের চেংডু শহরের রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট ফলের দোকান চালাতেন। একদিন এক ক্রেতাকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্যে পাশের দোকানে টাকা ভাংতি করাতে গিয়েছিলেন মিংকিং, ৩ বছরের ছোট্ট মেয়ে কিফেংকে রেখে গিয়েছিলেন দোকানেই। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধান, কিন্তু ওই কয়েক মিনিটই মিংকিংয়ের জীবন ওলট পালট করে দিল। এসে আর মেয়েকে খুঁজে পাননি তিনি।
এরপর গোটা শহর ও তার আশেপাশের এলাকায় মেয়েকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন তারা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, অনলাইনে মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় আবেদন জানিয়েছেন। মেয়ে কিফেং ফিরে আসবে কেবল এই আশায় একদিনের জন্যেও তারা চেংডু ছেড়ে যাননি।
দীর্ঘ সময় খোঁজ করেও যখন মেয়ের কোন খোঁজ পেলেন না, তখন মিংকিং খোঁজার পরিধি আরও বাড়িয়ে দিলেন। ২০১৫ সালে স্থানীয় একটি ট্যাক্সি কোম্পানির চালক হিসেবে নিজের নাম নিবন্ধন করালেন। পেশা পরিবর্তন করে ট্যাক্সি চালক হলেন শুধুমাত্র এই আশায়, তাঁর মেয়ে কিফেং একদিন যাত্রী হিসেবে তারই ট্যাক্সিতে উঠবে! ট্যাক্সির পেছনের জানালায় বড় করে হারানো বিজ্ঞপ্তি লাগালেন, ট্যাক্সিতে যত যাত্রী উঠেছেন প্রত্যেককে লিফলেট দিয়েছেন, যদি কেউ তাঁর মেয়ের কোন খোঁজ দিতে পারে!
তিন বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া শিশু কিফেংয়ের কোন ছবি মিংকিংয়ের কাছে ছিল না। লিফলেটে তাই অনেকটা কিফেংয়ের মতই দেখতে নিজের আরেক মেয়ের ছবি ব্যবহার করেছেন।
বছরের পর বছর চীনা পুলিশ কিফেং অনুমান করে অনেক মেয়েকে শনাক্ত করেছেন, কিন্তু কারোর ডিএনএ’ই মিংকিংয়ের সাথে মিলছিল না। কিন্তু গত বছর অনলাইনে মিংকিংয়ের সম্পর্কে জানতে পেরে পুলিশের এক স্কেচ আর্টিস্ট মিংকিংয়ের সাহায্য এগিয়ে আসেন। তিন বছর বয়সের কিফেংয়ের বর্ণনা শুনে শুনে ২৭ বছরের কিফেং দেখতে কেমন হতে পারে, সেটা অনুমান করে করে একটা স্কেচ আঁকেন তিনি। ওই ছবিটা অনলাইনে ভাইরাল হয়।
হাজার কিলোমিটার দূরে, দেশের প্রায় অপর প্রান্তে কাং ইয়াং নামের এক তরুণী এই স্কেচটি দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে, স্কেচটি যে হুবহু তারই মুখের আদলে আঁকা! চেংডু থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের এক শহরে অন্য একটি পরিবারের পালিত সন্তান হিসেবে বড় হয়েছেন ইয়াং। ওই পরিবার থেকেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, তারা তাকে চেংডুর এক রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।
এরপর ইয়াং নিজে মিংকিংয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। মিংকিং বিস্মিত হয়ে খেয়াল করেন, মেয়েটির সাথে তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কি যেন একটা সাদৃশ্য রয়েছে। এরপর ভাল করে খেয়াল করার পর মিংকিং দেখেন, কিফেংয়ের মত এই মেয়েটির কপালেও একটা ছোট্ট কাঁটা দাগ আছে। আর কান্না করার সময় মেয়েটির কেমন গা গোলানো ভাব হয়, ঠিক যেমনটা হত কিফেংয়েরও।
এরপর পুলিশ তাড়াতাড়ি করে ডিএনএ টেস্টের আয়োজন করে। এবার আর হতাশ হতে হয়নি মিংকিংকে। পরীক্ষার ফলাফল আসলে তিনি জানতে পারেন, এই মেয়েটিই তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে কিফেং!
গত মঙ্গলবার প্রায় দুই যুগ পরে বাবা-মেয়ের পুনর্মিলন হয়। জিলিন প্রদেশ থেকে নিজের স্বামী-সন্তান নিয়ে চেংডুতে আসেন কিফেং। এরপর পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে দেখা হলে কেউই আর নিজেদের আবেগকে সামলে রাখতে পারেননি। বেইজিংয়ের এক পত্রিকাকে মিংকিং বলেছেন, ‘গত ২৪ টা বছর ধরে আমরা কত আশা, একই সাথে হতাশার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তা আমার পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। অবশেষে আমাদের দেখা হল!’
এদিকে বাবা-মেয়ের এই পুনর্মিলনের ঘটনা পুরো চীন জুড়েই সাড়া ফেলে দিয়েছে। অনেকেই এই বিস্ময়কর ঘটনা উদযাপনও করেছেন আনন্দের সাথে।
বিবিসি অবলম্বনে