মাস দুয়েক পরেই রাশিয়ায় বসতে যাচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপের ২১ তম আসর। সেই ১৯৩০ সালের প্রথম আসর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপেই ব্যবহৃত হয়েছে আলাদা আলাদা বল। ফুটবল ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাওয়া সেই বলগুলো নিয়েই আমাদের প্রিয়লেখার ধারাবাহিক আয়োজন। আজ প্রথম পর্বে থাকছে প্রথম সাতটি আসরের বলের গল্প। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ।
টিয়েন্টো & টি-মডেল; ১৯৩০ বিশ্বকাপ:
১৯৩০ সালের উরুগুয়ে বিশ্বকাপের জন্য কোন নির্দিষ্ট অফিশিয়াল বল ছিল না। একেক সময় একেক বল দিয়ে খেলা হত। ফাইনালের আগে দুই ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় কাদের বল দিয়ে খেলা হবে এই প্রশ্নে। শেষ পর্যন্ত কোন সমাধানে আসতে না পেরে এই সিদ্ধান্ত হয়, দুই অর্ধে খেলা হবে দুই দেশের যোগানকৃত বল দিয়ে!
এই সিদ্ধান্ত খেলার ফলাফলে প্রভাব রাখলেও রাখতে পারে। প্রথমার্ধে খেলা হয় আর্জেন্টাইনদের বল দিয়ে, প্রথমার্ধ শেষে তারা এগিয়ে থাকে ২-১ গোলে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলা হয় উরুগুয়ের তুলনামূলক বড় ও ভারী বল দিয়ে। এত ভারী বলে খেলে অভ্যস্ত না হওয়ায় তাল হারিয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা, ফলাফল প্রথম বিশ্বকাপ জয় স্বাগতিক উরুগুয়ের।
আর্জেন্টিনার বলটির নাম ছিল টিয়েন্টো, আর উরুগুয়ের বলটির আকৃতি ইংরেজি বর্ণ ‘টি’ এর মত হওয়ায় এর নাম দেয়া হয় টি-মডেল।
ফেডারডেল ১০২; ১৯৩৪ বিশ্বকাপ
দ্বিতীয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ইতালিতে, বেনিতো মুসোলিনির একনায়কতন্ত্রের অধীনে। তার সরকার থেকে বিশ্বকাপের জন্য ঠিক করে দেয়া হয় এই ফেডারডেল ১০২ বলটি, যদিও ইংল্যান্ডের কিছু বলও ব্যবহার করা হয়েছিল এই বিশ্বকাপে।
আগের বলের চেয়ে এই বলের স্বতন্ত্রতা ছিল, চামড়ার লেসের বদলে তুলার লেস ব্যবহার। এতে করে বলের ওজন অনেকটা কমে যায়, ফলে খেলোয়াড়দের জন্য বল হেড করতে সুবিধা হয় অনেক। কিন্তু বলগুলো হাতে নির্মিত হত বলে এর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেক। সে কারণে খেলা শুরুর আগে দুই দলের অধিনায়ককে দুটো বল দেখানো হত, তারপর তারা যেটা বাছাই করতেন সেটা দিয়ে খেলা হত। ফাইনাল খেলাটা অবশ্য হয়েছিল ইংলিশ বল দিয়ে, আর তাতে জিতেছিল স্বাগতিক ইতালিই।
অ্যালেন; ১৯৩৮ বিশ্বকাপ
এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে, আর এবারই প্রথমবারের মত কোন বাইরের প্রতিষ্ঠান বল তৈরির দায়িত্ব পায়। প্যারিসভিত্তিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান অ্যালেন এই বিশ্বকাপের বল যোগানের দায়িত্ব পায়।
এই বল অনেকটা আগের বিশ্বকাপের বলের মতই ছিল। আগের বলগুলোতে ১২ টি প্যানেল রাখা হলেও এটিতে রাখা হয় ১৩ টি। ফেডারডেল ১০২ এর সাথে এই বলের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্যটা ছিল, অ্যালেনের প্যানেলের কিনারাগুলো আগের বলের চেয়ে অনেক বেশি গোলাকার করা হয়েছিল। তবে এই বিশ্বকাপেও শুধুই অ্যালেন দিয়ে খেলা হয়নি, ১২ ও ১৮ প্যানেলের বল দিয়েও খেলা হয়েছিল।
ডুপ্লো টি; ১৯৫০ বিশ্বকাপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১২ বছর বিরতি দিয়ে আবারো শুরু হয় বিশ্বকাপ। আর এই দীর্ঘ বিরতিতে বলেও আসে অনেক পরিবর্তন।
এই বিশ্বকাপের বল তৈরি হয় আর্জেন্টিনায়, এবং সেটা প্রথমবারের মত তৈরি হয়েছিল ত্রিশের দশকেই। কেবল ফিফার অনুমতি পায়নি বলে আগে এই বল ব্যবহার করা হয়নি। অনেক বছর ধরে এই বল দিয়েই আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লীগে খেলা হত। তখন এর নাম ছিল ‘সুপারভাল’। এই বলের গুণগত মান তুলনামূলক ভাল হওয়ায় প্রথমবারের মত পুরো টুর্নামেন্ট একটি ব্র্যান্ডের বল দিয়েই শেষ করা হয়।
সুইস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন; ১৯৫৪ বিশ্বকাপ
প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ যায় সুইজারল্যান্ডে, তাই এবার বল প্রস্তুতকরণের দায়িত্ব পায় সুইজারল্যান্ডের বাসেল ভিত্তিক কোম্পানি কস্ট স্পোর্ট। এই বল আবারো ফেরত যায় ১৮ প্যানেল কাঠামোতে, আর প্রত্যেকটি প্যানেল একটি আরেকটির সাথে আড়াআড়িভাবে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। পরবর্তী কয়েক দশকেও বলের এই কাঠামো অনুসরণ করা হয়। বলের রং ছিল অনেকটা উজ্জ্বল হলুদ। তবে আগের বিশ্বকাপের বলে প্রস্তুতকারক কোম্পানির ব্র্যান্ডিং অনুমোদিত হলেও এই বিশ্বকাপ থেকে তা নিষিদ্ধ করে ফিফা।
টপ স্টার; ১৯৫৮ বিশ্বকাপ
সুইডেন বিশ্বকাপের আগে প্রথমবারের মত ফিফা বলের জন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বল প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে আহবান করা হয় একটি খামে তাদের বিস্তারিত লিখে ডিজাইন করা বল জমা দিতে। মোট ১০২ টি কোম্পানি এই আহবানে সাড়া দেয়। এরপর ফিফার কার্যনির্বাহী কমিটির চারজন ও সুইডিশ ফুটবল কর্তৃপক্ষের দুইজন, মোট ছয়জন মিলে বলগুলো পরীক্ষা করে দেখা শুরু করেন।
লাঞ্চ ব্রেকের আগেই সংখ্যাটাকে ছেঁটে দশে নিয়ে আসেন তারা। তারপর ঘণ্টা দুয়েক পরে ৫৫ নম্বর বলটিকে বিশ্বকাপের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাছাই করে তারা। এই ৫৫ নম্বর বলটির নাম ছিল টপস্টার, অ্যাঙ্গেলহোম নামক এক কোম্পানির তৈরি। এই বলটি ছিল ২৪ প্যানেলের বল। প্রত্যেক দলকে ৩০ টি করে বল দেয়া হয়েছিল আয়োজকদের পক্ষ থেকে, ব্রাজিল নিজ উদ্যোগে আরও বেশি সংখ্যক বল কিনে নেয়।
ক্র্যাক; ১৯৬২ বিশ্বকাপ
১৯৬২ সালের চিলি বিশ্বকাপের জন্য ক্র্যাক বলটি বাছাই করা হয়, কিন্তু বিশ্বজুড়ে বলটি খুব একটা সমাদৃত হয়নি। চিলিয়ান কোম্পানি কাস্টোডিও জামোরা কর্তৃক নির্মিত এই বলে প্যানেল ছিল ১৮ টি, কিন্তু সেগুলো অনিয়মিতভাবে ভাগ করা ছিল। কিছু চারকোণার, আবার কিছু ছয় কোণার।
বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দলগুলোর এই বল একদমই পছন্দ হয়নি। আগের বিশ্বকাপে ব্যবহার করা টপস্টার বল ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। শেষ পর্যন্ত শতাধিক টপস্টার বল জাহাজে করে চিলিতে পাঠানো হয় ব্যবহারের জন্য।