ছোটবেলায় আমরা অনেকেই দাতা হাতিম তায়ির নাম শুনেছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৯০ এর দশকে ডাবিংকৃত দাস্তান-ই-হাতিম তায়ি অনেকেরই মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আরব্য রজনীতে হাতিম তায়িকে নিয়ে গল্প রয়েছে, বিস্তর টেলিভিশন সিরিজ এবং চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে হাতিমকে নিয়ে। কেউ কেউ তো আবার এককাঠি সরেস। হাতিমকে ফিকশনাল চরিত্র বানিয়ে তৈরি করেছেন অবাস্তব সব গল্প। কেউ কেউ তো দাতা হাতিম তায়িয়ের বদলে তাকে জাদু কিংবা অবাস্তব জগতেরই একজন মানুষ মনে করে বসেন। আসলে কে এই হাতিম তায়ি? আসুন, আজ তার সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক।
তার নাম হাতিম আল তায়ি বা হাতিম তায়ি (এই নামেই মানুষ তাকে বেশি চেনে)। পুরো নামটি বেশ বড়, হাতিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সাদ আত তায়ি। দানশীলতার জন্য হাতিম তায়ি প্রবাদপুরুষসম। তিনি বসবাস করতেন আরব উপদ্বীপের হাইল অঞ্চলে। আরব্য রজনীতে তার জন্মস্থান ও সমাধির কথা বলা আছে। ব্যক্তি হাতিম তাইয়ের জীবনী সম্পর্কে আসলে খুব বেশি কিছু বলা যায় না। যা কিছু রয়েছে, বেশিরভাগই কিংবদন্তি। বর্তমান সময়ে এসে এসব গাঁথা যাচাই করার কিছু উপায় নেই তবে একথা অনেকেই স্বীকার করেন যে হাতিম তায়ি দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
বিখ্যাত ফার্সি কবি শেখ সাদী তার রচিত অপর গুলিস্তাঁয় লিখেছেন যে হাতিম বেঁচে নেই কিন্তু তিনি তার সদগুণের জন্য পৃথিবীর মানুষের বুকে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
হাতিমের কিংবদন্তি সম্পর্কে একটি চমৎকার গল্প রয়েছে। সত্যাসত্য যাচাই করবার উপায় নেই তবে বেশিরভাগ বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায় যে পিতামাতা তাদের জন্মের পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখতেন আসন্ন নবজাত শিশুর সম্পর্কে। হাতিমের একরাতে স্বপ্নে দেখলেন যে কেউ তাকে এসে বলছে হয় তিনি দশটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন, নয়ত একটিমাত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। তার সন্তান সমগ্র পৃথিবীতে নিজের নাম উজ্জ্বল করবে। হাতিমের মা দ্বিতীয় অপশনটিই বেছে নিলেন। দশটির বদলে একটিমাত্র সন্তান চাইলেন তিনি।
হাতিমের বাবা একদিন তার পুত্রকে পাঠালেন মাঠে গবাদিপশুগুলোকে ঘাস খাইয়ে আনার জন্য। হাতিম কিছু সময় পর খালি হাতে ফিরে এলেন। স্তম্ভিত বাবা এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে হাতিম বললেন যে তিনি পথেঘাটে অনেক দুঃখী অভাবী মানুষ দেখেছেন। তাদের কষ্ট সইতে পারছিলেন না। ফলশ্রুতিতে নিজেদের গবাদি পশুগুলো বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন। রাগান্বিত বাবা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলেন না। হাতিমের চোখেমুখে খেলা করছিল অপার্থিব এক আলোর নাচন। এ যেন মানুষের জন্য কিছু করতে পারার গর্ব!
তবে হাতিমকে বেশিদিন বাবার ছায়াতলে থাকার সৌভাগ্য ঈশ্বর দিলেন না। দাদার কাছে আশ্রয় হলো হাতিমের। বুড়ো মানুষের পক্ষে হাতিমকে সামাল দেয়া খুব কষ্টের ছিল। উপরন্তু, নিজেদের কাছে যা ছিল, সবকিছুই বিলিয়ে দিতেন হাতেম। খুব দ্রুতই দাদার কাছে থাকা সকল সম্পত্তি ফুরিয়ে যেতে শুরু করল। এরপরও হাতেমের মনে সুখের অন্ত ছিল না। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে যারপরনাই খুশি হতেন তিনি। ভালোবাসতেন কবিতা আবৃত্তি ও রচনা করতে। তার সময়ে কবিতা রচনায় হাতিমকে টেক্কা দিতে পারে, এমঞ্জ কবি খুব কমই ছিল। নিজ গ্রাম, গ্রামের মানুষ, তাদের আটপৌরে জীবন, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠত হাতিমের কবিতায়। কবিতা এবং কবিদের তিনি খুবই পছন্দ করতেন।
একদিন তার গ্রামে কিছু লোক বেড়াতে এল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাদের মাঝে তিনজন কবি আছেন যারা ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়েছেন। হাতিম যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। নিজের খামার থেকে সেরা তিনটি উট জবাই করলেন কবিদের খাওয়াবার জন্য। এরুপ মনোভাবনা দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন কবিরা। পরবর্তীতে তাদের কবিতায় উঠেছিল হাতিমের বদান্যতার কথা।
৫৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন মহান এই ব্যক্তি। হাইলের তুওয়ারিনে তাকে দাফন করা হয়েছে। তবে ১৭শ শতাব্দীর অরিয়েন্টালিস্ট ডি হারবেলটের মতানুসারে হাতেমের কবর আনোয়ারাজ গ্রামে অবস্থিত। তার সুপুত্র আদি ইবনে হাতিম ছিলেন তায়ি গোত্রের একজন নেতা এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর একজন সাহাবী।