সমীকরণটা একদমই সহজ ছিল জিম্বাবুয়ের জন্য। নিজেদের শেষ ম্যাচে জিতলেই বিশ্বকাপ নিশ্চিত। প্রতিপক্ষ আবার এমন এক দল, সুপার সিক্স পর্বে যারা কোন ম্যাচই জিততে পারেনি। নিজেদের মাঠ, চেনা কন্ডিশন, প্রতিপক্ষের নাম সংযুক্ত আরব আমিরাত- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাজি ধরার লোক খুব বেশি ছিল না। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে সেই আমিরাতের কাছে ডিএল মেথডে ৩ রানে হেরেই বিশ্বকাপ স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে গেছে জিম্বাবুয়ের। জিম্বাবুয়ের বদলে এখন বিশ্বকাপে খেলবে তাদেরই হারের সুযোগ নেয়া আফগানিস্তান। পরাজয়টা এমনই শেল হয়ে বিঁধছে জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটারদের মনে, বাছাইপর্বের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়া সিকান্দার রাজা তাই মন থেকে আক্ষেপ দূর করতে পারছেন না। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মনের ভেতরের সেই আক্ষেপ আর হতাশাই ব্যক্ত করেছেন এই জিম্বাবুইয়ান অলরাউন্ডার।
আপনি বলছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি আপনার কাছে বেদনাদায়ক, কারণ এটি বিশ্বকাপে উঠতে না পারার দুঃস্মৃতিকে বারবার উসকে দেবে। এই মুহূর্তে ঠিক কিরকম অনুভূতি হচ্ছে?
সিকান্দার রাজা : যন্ত্রণাটা এখনো কমেনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কমবেও না। সামনের বছরেই তো বিশ্বকাপ, তখনই আবার ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আমার মনে হয় যদি আমি এই যন্ত্রণা কাটিয়েও উঠি, তাহলেও যখনই আমি জিম্বাবুয়ে ও আরও কিছু দুর্দান্ত ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলা দলগুলোকে বিশ্বকাপে দেখব না, তখনই এই যন্ত্রণা আবার আমার বুক চিড়ে বের হবে। এটা আমাদের অনেক, অনেক দিন তাড়া করে বেড়াবে। মানতে কষ্ট হলেও এটাই নির্মম বাস্তবতা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ম্যাচের পরের সময়টাতে আমাদের ফিরিয়ে নিতে পারবেন একটু? ড্রেসিংরুমে কী কথাবার্তা হচ্ছিল তখন?
সিকান্দার রাজা : কিচ্ছু না। সবাই কাঁদছিল। আমি নিজেও কাঁদছিলাম। দেয়ালে মুখ লুকিয়ে রেখেছিলাম সবাই। কেউ কেউ কাপড়ে মুখ লুকাচ্ছিল। যার যার সিটে বসেছিল সবাই, কেউ একটা কথাও বলছিল না। কোচেরা (হিথ স্ট্রিক, ল্যান্স ক্লুজনার) এসে অনেক ভাল ভাল কথা বলছিলেন, কেউ কোন জবাব দিতে পারিনি আমরা। বাস্তবতা হল আমরা কেউই জানিনা ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কি লুকিয়ে রেখেছে। ওই ড্রেসিংরুমে কে আবার ফিরবে, কে ফিরবে না কিছুই জানিনা আমরা। অনেক কিছুই বদলাতে পারে, কিন্তু আমরা কিছুই জানিনা।
কিন্তু এটাও দুঃখের বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় দুঃখ বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়াটা। এখন পর্যন্ত কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ করিনি আমরা। যা হয়েছে তা মেনে নিতে সময় লাগছে প্রত্যেকেরই। ঈশ্বরই জানেন এই ক্ষত শুকাতে কতদিন সময় লাগবে।
সৌভাগ্যবশত আমি গাজী ট্যাঙ্কের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ খেলতে ১০ দিনের জন্য জিম্বাবুয়ের বাইরে যাচ্ছি। স্বভাবতই আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে এটা আমাকে সাহায্য করবে। যারা জিম্বাবুয়েতে থেকে যাচ্ছে তাদের জন্য আমার খারাপ লাগছে, কারণ তারা যেখানেই যাবে প্রত্যেকটা জায়গা তাদের সেই দুঃস্মৃতিকে মনে করিয়ে দেবে।
বিশ্বজুড়ে অন্যান্য ঘরোয়া লীগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন আপনি। জিম্বাবুয়ের হয়ে পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্টে কি খেলবেন আপনি?
সিকান্দার রাজা : আমাদের পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট খুব সম্ভবত জুলাইতে, অস্ট্রেলিয়া ও আরেকটি দল নিয়ে একটি ত্রিদেশীয় টি-২০ টুর্নামেন্ট। এর পরে বা আগে পাকিস্তানের সাথে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ আছে। অর্থাৎ প্রায় ৩-৪ মাস আমাদের সামনে কোন খেলা নেই।
আমার মনে হয় আমাদের বোর্ডের সাথে বসা উচিত, তারা কি বলে তা শোনা উচিত। আমাদের সিদ্ধান্ত অনেক কিছুর উপরেই নির্ভর করবে। এখনই আমি আপনাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না, কারণ এখন আমি আবেগাক্রান্ত। আর আবেগতাড়িত হয়ে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইনা। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে পরিবারের সাথেও আলোচনা করতে হবে আমাকে। এই ডিপিএল এর চেয়ে ভাল সময়ে হতে পারত না আমার জন্য। আশা করছি ক্রিকেটের সাথে থেকে আরও ভাল কিছু দেখতে পাব।
যখন নিজের সেরা সময়ে আছেন, তখনই বিশ্বকাপটা মিস করবেন। এটাও নিশ্চয়ই পোড়াচ্ছে আপনাকে?
সিকান্দার রাজা : আমি সেরা ফর্মে থাকা সত্ত্বেও দল বাছাইপর্ব উতরাতে পারেনি, এটা নিয়ে কোন আফসোস নেই। এরচেয়ে আমি যদি কয়েকটা ডাকও মারতাম, বেশি রান না করতাম, বা বেশি উইকেট না নিতাম, কিন্তু বিশ্বকাপে জায়গা পেতাম, আমি অনেক বেশি খুশি হতাম। দিনশেষে এটা একটা দলীয় খেলা, আমরা সবাই একে অপরের সাথে চলি। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি একটা দল মানে একগুচ্ছ ভাইয়ের সমষ্টি।
বিশ্বকাপে উঠতে পারলে আমাদের কেউ কেউ তাদের শেষ বিশ্বকাপটা খেলতে পারত। একমাত্র আফসোস এটাই, আমাদের কাউকে কাউকে হয়তো বিশ্বকাপ না খেলেই ক্যারিয়ার শেষ করতে হবে।
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে টুর্নামেন্টের অন্য দলগুলো সম্পর্কেও বলছিলেন। প্রতিষ্ঠিত টেস্ট খেলুড়ে দেশ হয়েও কি বাকিদের সাথে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করছেন?
সিকান্দার রাজা : এই টুর্নামেন্ট নিশ্চিতভাবেই অনেকগুলো দেশকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আমরা তো তাদের বিপক্ষে খুব কমই খেলার সুযোগ পাই। এই পর্যায়ে আসতে কি পরিমাণ প্যাশন, কঠোর পরিশ্রম আর প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আসতে হয়েছে তাদের, আমরা সবাই তা দেখেছি। আত্মীয়তা কিনা জানিনা, কিন্তু আমি ওদের সবার জন্যই দুঃখিত, যাদের সত্যিই বিশ্বকাপের অংশ হওয়াটা প্রাপ্য।
উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড ও আয়ারল্যান্ডের সকলের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তাদের কথা আমার মনে ছিল, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি এমনই আবেগাক্রান্ত ছিলাম, ওদের কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাদেরও বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়াটা সমান প্রাপ্য ছিল।
ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে