স্টিফেন হকিং বোধহয় বর্তমান পৃথিবীর এমন একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি মহাবিশ্বটা খুব ভালোমতোই বুঝতে পারতেন, বোঝাতে পারতেন। আ ব্রিফ হিস্টোরি ইন টাইম নামক বইটিতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কে তিনি এত চমৎকারভাবে লিখেছেন যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা মানুষও সহজেই এর প্রকৃত রসটির কিছুটা হলেও আস্বাদন করতে পারবে। গত ১৪ মার্চ ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে মারা গিয়েছেন প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানী। কথা বলতে না পেরেও যন্ত্রের সাহায্যে এমন এমন সব কথা বলে গিয়েছেন এই বিজ্ঞানী, যাতে করে মনে হচ্ছে তার করা কিছু ভবিষ্যদ্বানী অচিরেই মিলে যাবে। যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তার করা মন্তব্যটি নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সারা বিজ্ঞানী মহলে। সত্যিই কি একদিন মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
পরিবারের লোকজন, সহকর্মী এবং অনেকেই রয়েছেন যারা তার কথা এবং কাজের মাধ্যমে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। জীবনকে উপভোগ করেছেন হকিংকে সাথে নিয়েই। যদি তার জীবনের সেরা উক্তিগুলোর দিকে ফিরে যাই, তাহলে এমন কিছু কথার সাথে আমাদের পরিচিত হতে হবে, যেগুলো শুনলে চমকে উঠতে হয়। কি ছিল কথাগুলো? বিশেষ করে ভিনগ্রহের প্রাণী, নারী এবং মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন স্টিফেন। তার কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য নিয়েই আজকের এই আয়োজন-
২০১৭ সালের নভেম্বরের ৫ তারিখে বেইজিং-এর টেনসেন্ট ওয়েব সামিটে অনুষ্ঠিত এক ভিডিও প্রেজেন্টেশনে বিখ্যাত এই কসমোলজিস্ট ক্রমাগত এই বেড়ে যাওয়া মানব সভ্যতা নিয়ে আগামীকে বেশ ভালোভাবেই হুঁশিয়ার করে গিয়েছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সান এর মতে, বর্তমান মানব সভ্যতার যে প্রয়োজন ও চাহিদা, তাতে করে দেখা যাচ্ছে এই বিজ্ঞানী ধারণা করে গিয়েছিলেন ২৬০০ সালের মধ্যেই এই পৃথিবী বসবাস করবার একেবারেই অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।
“মহাবিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাণীকুল হিসেবে আমাদের কি এগুলো উপভোগ করা উচিত নয়? উচিত নয় কি একটি বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করা? উত্তর হচ্ছে, না।” ২০১৭ সালের ২০ জুন স্টারমাসের একটি বক্তৃতায় হকিং এমন ধরনের একটি কথা বলেছিলেন। নরওয়েতে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে হকিং আরো বলেন, “আমাদের পৃথিবী এত এত দিক থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এর সম্পর্কে ইতিবাচক হওয়া আমার জন্য বেশ কঠিন।”
২০১৬ সালের একটি ডকুমেন্টারিতে স্টিফেন বলেন, “এমন একদিন আসবে, যখন আমরা আমাদের পৃথিবীর মতোই কোনো একটি গ্রহ থেকে সাড়া পাব। তবে আমাদের মূল বিষয় হবে এই সাড়ার প্রত্যুত্তর কীভাবে করা উচিত। হতে পারে তারা আমাদের থেকেও অনেক অনেক বেশি উন্নত হবে জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়। নেটিভ আমেরিকানরা কলম্বাসকে দেখে যেমন বোধ করেছিল, আমাদের অবস্থাও হয়ত ঠিক এমনই হবে।” গ্লিজ ৮৩২সি নামক এক কল্পিত গ্রহের দিকে ইঙ্গিত করে স্টিফেন ডকুমেন্টারীতে এই কথাগুলো বলেন,কিউরিওসিটিস্ট্রিম ভিডিও সার্ভিসে ভিডিওটি প্রকাশিত হয়েছিল।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেয়া ২০১৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে স্টিফেন বলেন, “মানবসভ্যতার বিপর্যয়ের জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হবে এদের অতিমাত্রায় অপরকে আঘাত করবার প্রবণতা এবং ধৈর্য্যচ্যুতি। অতীতের মানুষের দিকে তাকিয়ে যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন যে খাদ্য, বাসস্থান, কিংবা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অপরের সাথে এই প্রতিযোগিতাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে সুবিধা দিয়েছে। তবে বর্তমানে দিন যত এগুচ্ছে, মানুষ তত বেশি আধুনিক হচ্ছে কিন্তু মগ্ন হয়ে যাচ্ছে আরো বেশি বর্বরতার দিকে। এই জিনিসগুলো কমাতে না পারলে ভবিষ্যতের জন্য আমরাই নিজেদের হুমকি হয়ে উঠব।” লন্ডনের সাইন্স মিউজিয়ামে ভ্রমণকালে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন স্টিফেন।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে ২০১৭ সালের জুনে বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্টিফেন বলেন, “আমরা এমন একটি মাত্রায় এসে পৌছেছি যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। ট্রাম্প যেসকল কর্মসূচি নিচ্ছেন, তাতে আর খুব বেশি দেরি নেই যে তিনি পৃথিবীকে ভেনাসে পরিণত করবেন। এখানে তাপমাত্রা হবে ২৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং আকাশ থেকে ঝরবে এসিড বৃষ্টি।”
২০১৩ সালের এপ্রিলের ১৬ তারিখে “দ্য অরিজিন অব দ্য ইউনিভার্স” শীর্ষক একটি লেকচারে স্টিফেন বলেন, “সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কী করছিলেন? নাকি এইমাত্র যে প্রশ্নটি করলাম, এধরনের প্রশ্নজিজ্ঞাসু লোকজনের জন্য নরক তৈরি করছিলেন?” বলাই বাহুল্য, স্টিফেনের এই উক্তি যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ধর্মানুভুতিসম্পন্ন মানুষের মনে প্রচন্ড আঘাত করে স্টিফেনের এই আলটপকা মন্তব্য।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে স্টিফেন তার আশঙ্কা প্রকাশ করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন ও বিকাশ নিয়ে। তিনি বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটছে, আমি আশঙ্কা করছি মানব সভ্যতার সামনে এগিয়ে যাওয়াকে প্রচন্ডভাবে অবরুদ্ধ করতে পারে এই প্রযুক্তি। এখনই এর থেকে সাবধান হওয়া উচিত।”
স্টিফেন তার অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত বই আ ব্রিফ হিস্টোরি ইন টাইমে বলেছেন- “বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে আপনি দেখবেন যে সবকিছু রাতারাতি ঘটে যায় নি। তবে ঘটনাগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়েছে। এর কিছু হতে পারে ঈশ্বরপ্রদত্ত, আবার নাও হতে পারে।” বলাবাহুল্য, এই কথাটিও ধর্মীয় সংঘটনগুলো খুব ভালোভাবে নেয়নি।
২০০৫ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এমা ব্রোকসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টিফেন হকিং বলেন, “আমার শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করাটা আসলে বেকার। সবাইকে তার জীবন চালিয়ে নিতে হয় আর আমার মনে হয় আমি খুব খারাপ কিছু করিনি। কোনোকিছু নিয়ে সবসময় রাগ কিংবা হতাশা প্রকাশ করলে তা দেখার এত সময় মানুষের নেই।”
নারীদের সম্পর্কে চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেন স্টিফেন হকিং । নামজাদা এই পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে নারী বোধহয় চিরকাল একটা রহস্য হয়েই থেকেছিল। ২০১৫ সালের একটি রেডিট আমায় (ReDDit AMA) স্টিফেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন জিনিসটা তিনি এখনও বোঝেন না এবং কেন? সপ্রতিভ স্টিফেন হকিং জবাব দেন, “অবশ্যই নারী। আমার পিএ আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দেয় যে পদার্থবিজ্ঞানে আমার একটি পিএইচডি আছে, তবে নারী বিষয়ক যে কোনো কিছু আমার কাছে রহস্য হয়েই থাকবে।”
মৃত্যু নিয়ে স্টিফেনের ভাবনাটাও ছিল বেশ সহজ ও স্পষ্ট। গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মৃত্যু নিয়ে তার ভাবনা কী, তা জানতে চাইলে স্টিফেন বলেন,
“মস্তিষ্ক হচ্ছে একটি কম্পিউটার। যন্ত্রাংশগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিলে কম্পিউটারটিও অচল হয়ে যাবে। অচল কিংবা ভাঙা কম্পিউটারের জন্য স্বর্গ নরক বলে কোনো ব্যাপার আছে, তা আমার মনে হয় না। অন্ধকারে ভয় পাওয়া মানুষগুলোর জন্য এটি রুপকথা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।”
না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন স্টিফেন হকিং । তবে তার ভাবনাগুলো রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য। সত্যিই কি একদিন আমরা পাব ভিনগ্রহবাসীর ডাক? সত্যিই কি আমাদের ওপরের এই নীলাকাশ থেকে ঝরবে এসিড বৃষ্টি? সুজলা সুফলা এই পৃথিবীতে সত্যিই কি আমরা খুব বেশিদিন আর টিকতে পারব না? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অচিরেই ছড়ি ঘোরাতে আসছে আমাদের ওপর? কে জানে! তবে প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানীর মৃত্যু যে আমাদের জন্য বিশাল একটি ধাক্কা, সে কথা বলাই বাহুল্য।
(তথ্যসূত্রঃ লাইভ সাইন্স)