দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহরু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। জওহরলাল নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। ভারতে তুমুল জনপ্রিয় নেহরুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা-সমালোচনা চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। প্রিয়লেখার পাঠকদের জন্য আজ থাকছে তারই অংশবিশেষ।
জওহরলাল নেহরু
এডউইনার সাথে নেহরুর পরিণয় নিয়ে কথা বলার আগে তাদের পৃথক পৃথক বিবাহিত জীবনের দিকে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। কমলা নেহরুর সাথে জওহরলাল নেহরুর বিয়েটা খুব একটা সুখকর ছিল না। নেহরুর ভাগ্নি নয়নতারা সেহগালের দেয়া তথ্যানুযায়ী, নেহরু তার আর কমলার সংসার জীবনকে ‘সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুজন ব্যক্তির জীবনের অন্যতম বড় একটি ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে এডউইনার বৈবাহিক জীবনও এর চেয়ে খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। বিয়ের আগে এবং পরে এডউইনার বেশ কিছু প্রেমিকের কথা বিভিন্ন সময় শোনা গেছে। ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে, স্যান ফ্র্যান্সিসকো ক্রনিক্যালস পত্রিকায় গসিপ পাতায় মিসেস মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে যাচ্ছেতাই ভাষায় সংবাদ প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
ভারতবর্ষের সর্বশেষ বড়লাট এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন প্রায় পাঁচ বছর ব্যাপী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের প্রধান নৌসেনাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সরকার তাকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠায়। সে বছরের আগস্ট মাসেই ভারত ছেড়ে চলে যান তিনি, তবে তার আগে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত ও পাকিস্তান। সংক্ষিপ্ত এই ভারত সফরে তার সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী এডউইনা মাউন্টব্যাটেন এবং ১৭ বছর বয়সী কন্যা পামেলা। তখনই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এডউইনা। এমনকি তাদের সম্পর্ক শারীরিক পর্যায়েও পৌঁছেছিল বলে গুজব শোনা যায়।
জওহরলাল নেহরু ‘র সাহচর্যে ব্যতিক্রমী কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন এডউইনা, নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো তাদের। এ ব্যাপারে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিছু জানতেন কিনা তা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত প্রশ্ন ছিল সাধারণ জনগণের মনে। পাঁচ বছর আগে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পামেলা প্রকাশ করে তার বই ‘ডটার অফ অ্যাম্পায়ার: লাইফ অ্যাজ এ মাউন্টব্যাটেন’। সেখানে এডউইনা এবং নেহরুর মধ্যকার শ্রদ্ধা ও পবিত্র ভালোবাসার সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে পামেলা, তবে সে সম্পর্ক যে কখনো যৌনতার পর্যায়ে গড়ায়নি তাও স্পষ্ট করে জানিয়েছে সে। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ নিজের পান্নার আংটিটি নেহরুকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এডউইনা। তবে নেহরু যে সেটা নেবেন না তা বুঝতে পেরে নেহরুর কন্যা ইন্দিরাকেই উপহারটি দিয়ে যান তিনি। ১৯৪৮ সালের জুন পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করে ব্রিটেনে ফিরে যান লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ৫৮ বছর বয়সে এডউইনা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সাথে চিঠির মাধ্যমে নেহরুর সম্পর্ক অটুট ছিল বলে জানা যায়।
ব্যক্তিজীবনে রূচিবান পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জওহরলাল নেহ্রু । তাঁর পরিধেয় বহুল ব্যবহৃত প্রিয় কোটটি নেহেরু কোট নামে পরিচিত। নেহেরু ফ্যাশনের সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়টি হচ্ছে যে-কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্রধর্মী এই কোটটি পরতেন তিনি। নিজের ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ এই ভিন্নতর পোষাকের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে তিনি। এসব কারণেই হয়তো তার প্রতি আরও আকৃষ্ট হয় এডউইনা। মা এডউইনা ও নেহরুর সম্পর্কের বিষয়ে বিশদ জানার আগ্রহ ছিল পামেলার। এ জন্য তাঁদের পরস্পরকে পাঠানো কিছু ব্যক্তিগত চিঠি তিনি পড়েছিলেন। সেখান থেকেই তিনি জেনেছিলেন, এডউইনা ও নেহরু পরস্পরকে অসম্ভব ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন।
পামেলা বলেন, ‘মা ও নেহরুর সম্পর্কটা শারীরিক সম্পর্কের দিকে গড়িয়েছিল কি না, তা জানার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু চিঠিগুলো পড়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে তাঁদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। তাঁরা দুজন কখনো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একা হতে পারেননি। কারণ সব সময় পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা ও অন্যান্য মানুষ তাঁদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন। এ কারণেই তাঁরা শারীরিক সংসর্গের সুযোগ পাননি।’ পামেলা তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নেহরুকে একটি পান্নার আংটি দিতে চেয়েছিলেন মা এডউইনা। মা জানতেন, সেটা তিনি নেবেন না। পরে মা আংটিটি নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে দিয়ে বলেছিলেন, যদি তিনি (নেহরু) কখনো আর্থিক সংকটে পড়েন, তাহলে চাইলে আংটিটি তাঁর জন্য বিক্রি করে দিতে পারেন।’
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিদায় অনুষ্ঠানে জওহরলাল নেহরু এডউইনাকে সরাসরি উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনি যেখানেই যান না কেন, আমাদের আপনি আশা ও উৎসাহ দিয়ে গেলেন। ভারতের জনগণ আপনাকে ভালোবাসবে, তাদেরই একজন হিসেবে আপনাকে দেখবে। আপনার চলে যাওয়ায় তারা দুঃখিত।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ডটার অব এম্পায়ার: লাইফ অ্যাজ অ্যা মাউন্টব্যাটেন’ বইটি ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে তা পেপারব্যাক আকারে ভারতে নিয়ে আসা হয়৷