আত্মহত্যা মহাপাপ এই কথাটি আমরা সবাই জানি। বিভিন্ন ধর্মেও আত্মহত্যা নিষেধ করা হয়েছে। স্রষ্টার দেয়া এই মূল্যবান জীবনকে নষ্ট করবার অধিকার মানুষের হাতে নেই, এটা বেশ ভালোভাবেই বলা হয়েছে। ধর্মতত্ত্ব বাদ দেয়া যাক। সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি দেখি, আত্মহত্যার কোনো উপযোগিতা নেই ; বরং একটি জীবন ধ্বংস হয়ে গেলে সমাজের কোনো ধরনের উপকার হবে না, অপকারই হবে। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় ও বিভিন্ন সংবাদে দেখতে পাই নিতান্তই তুচ্ছ কারণে বর্তমান ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যার মতো কাজের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এসবদিকে যদি একটি দৃষ্টিপাত করা যায় , তাহলে বেশ কিছু কারণের দিকে নজর দিতে হয়।
১) পারিবারিক কলহ
২) প্রিয়জনের সাথে বিবাদ
৩) হতাশা
৪) বেকারত্ব
৫) সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার
৬) একাকীত্ব
৭) আরো নানা ধরনের কারণ
আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে একাকীত্ব খুব বড় একটি কারণ নয় তবে উন্নত বিশ্বের দিকে যদি দেখি, তাহলে দেখব এই একাকীত্বের কারণেই নিজের হাতে প্রাণ সংহার করছেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা। এবার আমাদের দেশের দিকে ফিরে আশা যাক। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রের আত্মহত্যা বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে। অনেকেই কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা, সহপাঠীদের হাতে হেনস্থার শিকার, দারিদ্র্য, পারিবারিক নানা সমস্যা, নিজ বিভাগের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে না পারা এবং আরো অনেক গৌণ কারণ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের সকলের জীবনে ছোট বড় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিয়েই আমরা বাঁচি, সমাধান করবার চেষ্টা করি, এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিই সামনের দিকে। আত্মহত্যা কেবলমাত্র এই সমস্যাগুলো থেকে পালিয়ে যাবার একটি ছুতোমাত্র। অনেকে বলবেন একজন মানুষের জীবনে কোন ধরনের সমস্যা থাকে, তা অন্য কেউ জানে না বা বুঝতে পারে না। আত্মহত্যার পরিকল্পনা মানুষ কোন পর্যায়ে গিয়ে নেয়, তা সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই বলে অনেকে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করতে পারেন। তবে আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশে নিজ হননের প্রবণতা রয়েছে। তাদেরকে সাহায্য করবার জন্য প্রতিষ্ঠান কিংবা কাউন্সিলরেরও অভাব নেই। একসাথে বসে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বলেন, বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। ভোগবাদী এই সমাজে মানুষের মাঝে যখন কেবলই হাহাকার, তখন চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে মেলবন্ধন ঘটাতে না পেরে তাদের মধ্যে এক ধরনের মনোবিকার ঘটাটাই স্বাভাবিক। তবে এর মোকাবিলা করবার জন্য দরকার পর্যাপ্ত সাহায্য ও মানসিক তুষ্টি। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) বাংলাদেশের বর্তমান এই সমস্যাগুলো নিয়ে খুবই চিন্তিত। সারাবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও যেন আত্মহত্যার হিড়িক পড়েছে। অনেকে আবার এটিকে চলতি ট্রেন্ডের সাথেও তুলনা করে থাকেন।
স্বামীর সাথে কলহ হয়েছে। ফোন দিয়ে তাকে জানান দিয়ে আত্মহত্যা করলেন গৃহবধূ।
পছন্দসই জামা কিনে দেয়া হয় নি। অভিমানে কন্যা আত্মহত্যা করেছে।
পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হয়েছে। বাবা মায়ের বকুনিতে অভিমান করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এক ছাত্র।
পত্রিকার পাতা খুললে হরহামেশাই এই ধরনের খবর আমরা দেখতে পাই। কথাবার্তা বলা হয়, আফসোস করা হয়, রাগ করা হয়। কোনো ধরনের সমাধানে আসা হয় না। আত্মহত্যা করবার কারণ কী, তা নিয়ে নানা ধরণের গবেষণা করা হয় কিন্তু কোনো ধরনের ক্যাম্পেইন চালানো হয় না। যারা আত্মহত্যা প্রবণতায় দিন দিন ঝুঁকে যাচ্ছে, ঐ তরুণ সমাজের সাথে খোলামেলা আলাপ আলোচনা করা হয় না। অথচ খুব ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই কিন্তু এই ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে তাদেরকে সরিয়ে আনা যায়। কীভাবে?
মানুষ সবসময় নিজের সমস্যাগুলোকেই বড় করে দেখে। তাই আশেপাশের দিকে মনোযোগ দেবার সময় খুব কম। অথচ আমাদের চারপাশেই কিন্তু অনেক মানুষ রয়েছে যারা খুব কষ্ট রয়েছে। কনকনে শীতের রাতে পাতলা একটি কাঁথা মুড়ি দিয়ে রাস্তায় ঘুমিয়ে আছে ছিন্নমূল মানুষের দল। খাবার নেই, গায়ে জামা নেই, কষ্টের সীমা পরিসীমা নেই।
তারপরও আত্মহত্যা করছে না। দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করছে। আসুন না, একটিবার সময় করে আমরা বাইরে যাই, প্রকৃতির কাছে যাই। পাহাড়ের কাছে যাই, নদীর কাছে যাই, অরণ্যের মুখোমুখি হই। মানুষ আমাদের চাইতেও অনেক বড় কষ্টে আছে। তাদের থেকে দেখে শিখি নতুন নতুন দর্শন।
পরিবারের সাথে রাগ করেছেন? চলুন না তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই! মনের সব কথাগুলো খুলে বলি। একটা সমাধানে আসতে চেষ্টা করি। পরিবার যদি আমাদের বুঝতে না পারে, তাহলে আর কে পারবে বলুন? প্রিয়জনের সাথে ঘটে যাওয়া নানা সমস্যাগুলো এক চুটকিতেই সমাধান হয়ে যেতে পারে যদি আমরা তাদেরকে নিজের অবস্থানটা সামনাসামনি প্রকাশ করতে পারি, মেলে দিতে পারি মনের সকল অব্যক্ত কথাগুলো ।
কে জানে, হয়তো ছোট একটি ঘটনাই আমাদের জীবনটা পাল্টে দিতে পারে !
সবশেষে আবারো একটি কথাই। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।