কে এই মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো
মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৪৫ থেকে মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত দুর্দণ্ড প্রতাপে দেশ পরিচালনা করেন। কমিউনিস্ট নামীয় রাজনৈতিক দলের তিনি সদস্য ছিলেন। তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে অবস্থান করে যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করা। পরবর্তীতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। যুগোস্লাভিয়ার বিবাদমান বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে তা গৃহযুদ্ধের রূপান্তরিত হয়ে দেশটি ভেঙ্গে যায়।
তিনি তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অংশ হিসেবে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার কুমরোভেচ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন স্লোভাক ও বাবা ছিলেন ক্রোয়েশিয় গ্রামীণ কৃষক। জীবনের শুরুতে তালাকর্মী হিসেবে টিটো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৪-১৯১৮ মেয়াদে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে নন-কমিশন্ড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ের যুদ্ধে আহত হলে তিনি প্রতিপক্ষের হাতে আটক হন ও যুদ্ধবন্দী হিসেবে রাশিয়ায় প্রেরিত হন। সেখানেই তিনি সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা নেয়ায় যুদ্ধশেষে তিনি সম্মানিত হন। ১৯১৭ সালে অনুষ্ঠিত রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের পক্ষাবলম্বন করেন টিটো।
যুদ্ধের পর তিনি ক্রোয়েশিয়ায় ফিরে আসেন ও অবৈধভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এসময়ে তিনি ধাতবমিস্ত্রী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। অবৈধভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হিসেবে কর্মকালীন সময়ে তিনি ছদ্মনাম হিসেবে টিটো নাম গ্রহণ করেন। এরফলে তিনি ১৯২৮ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন। টিটো নাম ধারণ করে পুণরায় মস্কো ফিরে যান ও ইন্টারন্যাশনাল (কোমিনটার্ন, পরবর্তীতে কোমিনফর্ম) নামীয় সাম্যবাদী দলের হয়ে কাজ করেন।
১৯৩৬ সালে কোমিনটার্ন টিটোকে যুগোস্লাভিয়ায় প্রেরণ করে সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করার জন্যে। পরের বছর যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। কোমিনটার্ন নীতির সাথে একাত্মতা পোষণ ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস রাখেন তিন। অন্যান্য যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদের উপর সার্বিয় আধিপত্যবাদের সমালোচনা করেন। যুগোস্লাভিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নে নাজি জার্মানির আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে টিটো সর্ব-দলীয় যুগোস্লাভ সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। আগ্রাসী জার্মান, ক্রোয়েশিয় ফ্যাসিবাদী ও সার্বিয় জাতীয়তাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেন। প্রাথমিকভাবে রক্ষণাত্মক ভঙ্গীমায় জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ করে তাঁর বাহিনী। ১৯৪২ সালে তিনি সমাজতান্ত্রিকশাসিত আঞ্চলিক সরকার গঠন করেন। এরফলে তাঁকে সার্বিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সেন্টিক দলের সাথে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে হয়। বিদ্রোহী দলগুলোর সাথে একত্রিত করার সফলতাবিহীন প্রারম্ভিক প্রচেষ্টা পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ব্যক্ত করে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
প্রথমদিকে মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো স্ট্যালিনের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন তাঁর কিছু কর্মকাণ্ডে সমালোচনা করলে তিনি স্ট্যালিনের সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এরফলে ১৯৪৮ সালে যুগোস্লাভ দল কোমিনফর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয় ও সোভিয়েত প্রাধান্য অথবা যুগোস্লাভিয়ার স্বাধীনতা – এ দুটি পছন্দের যে-কোন একটিকে বেছে নিতে বলা হয়। তিনি স্বাধীনতাকেই বেছে নেন যা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সমাদৃত হয়। এ সময় ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিল। টিটো মার্কসবাদের মানবতা দিক বিবেচনায় এনে শ্রমিকদের স্ব-ব্যবস্থাপনা ও উদার অর্থনৈতিক পুণঃগঠনের প্রস্তাব আনেন। দলীয় কার্যকলাপকে বিকেন্দ্রীয়করণ ও সরকারের ক্ষমতাও এর আওতাধীন ছিল। ফলশ্রুতিতে প্রজাতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী প্রবণতা নবরূপে বৃদ্ধি পায়।
মার্চ, ১৯৪৫ সালে টিটো স্বীকৃত প্রধানমন্ত্রী হন। এ বছরের শেষদিকে জার্মানরা যুদ্ধে পরাভূত হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি একীভূত হয় ও টিটোর সরকার দেশের পূর্ণ কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে। রাজতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের বিষয়ে কোনরূপ সংবিধান প্রণয়ন ব্যতিরেকেই টিটো একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯৪৫-১৯৬৩ মেয়াদকালে যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬০-এর দশকে এশীয় ও আফ্রিকার দেশগুলোর নেতৃবর্গসহ ভারত ও মিশরের রাজনীতিবিদদের সাথে নিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারণা তুলে ধরেন ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী ভূমিকা নেন মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো । এদেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে মুক্ত ছিল। প্রত্যেক দেশই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারতো এবং যথাসাধ্য ঠাণ্ডা যুদ্ধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানান। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক এবং তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় বিশ্বের সমর্থন জোরদার করে। ১৯৮০ সালের ৪ঠা মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।