পাহাড় আর মেঘের অদ্ভুত সুন্দর লুকোচুরি, কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য আর ফেলুদাতে সত্যজিৎ রায়ের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা, সব মিলিয়ে বাঙালিদের কাছে দার্জিলিংয়ের একটি ভালো চাহিদা রয়েছে। কিন্তু যাদের দার্জিলিং দেখা এরই মধ্যে হয়ে গেছে, তারা যদি আরেকটু দূরে কোথাও ঘুরে আসতে চান, তাহলে নিশ্চিন্তে গ্যাংটক থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কথা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না!
গ্যাংটক হল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিমের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। পূর্ব হিমালয় পর্বতশ্রেণির শিবালিক পর্বতে ১৪৩৭ মিটার উচ্চতায় এই গ্যাংটকের অবস্থান। মাত্র ৩০ হাজার বাসিন্দার এই শহরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কথায় বর্ণনা করে শেষ করা অসম্ভব। হিমালয় পর্বতমালার সুউচ্চ শিখরগুলির মাঝখানে মনোরম ও আরামদায়ক পরিবেশে গ্যাংটকের অবস্থান।
ইতিহাস
১৮৪০ সালে এনচে মঠ নির্মাণের পর থেকেই বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে গ্যাংটকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৮৯৪ সালে তৎকালীন সিকিম রাজা খুতোব নামগিয়াল গ্যাংটককে রাজধানীতে রুপান্তর করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তিব্বতের লাসা ও কলকাতার মধ্যে বাণিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামস্থলে পরিণত হয় গ্যাংটক। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর সিকিম ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসত্ত্বা বেছে নেয়, গ্যাংটক ছিল এই স্বাধীন ভূমির রাজধানী। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যোগ দিলে ভারতের ২২ তম রাজধানী শহরে পরিণত হয় গ্যাংটক। শহরটির অধিকাংশ লোকই নেপালি, লেপচা ও ভুটিয়া।
আকর্ষণীয় ও মনোরম গ্যাংটক
গ্যাংটক ও এর আশেপাশের অঞ্চল পুরোটাই সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে ঘেরা। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ, সাথে বিচিত্র প্রাণিকুল মিলিয়ে গ্যাংটক হয়ে উঠেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। রডোডেন্ড্রন, অর্কিডের ন্যায় ফুল, সাথে লাল পান্ডা, লাল রঙ্গিন পাখি এগুলো গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। গ্যাংটকে পর্যটকদের মন মাতানোর জন্য অনেক হ্রদ, ঝর্ণা ও পাহাড় রয়েছে। তবে এদের মধ্যে সোমগো ও মেনমেকো হ্রদই বেশি পরিচিত। দার্জিলিংয়ে যেই কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য নিয়ে এসেছেন, সেই সৌন্দর্য থেকে আপনাকে বঞ্চিত করবে না গ্যাংটকও। বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন আপনি পাবেন গ্যাংটক থেকেও। উষ্ণ ঝর্ণাগুলো সালফারের উচ্চ ঘনত্বের কারণে ভেষজ গুণের জন্য সুপরিচিত। পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয় উষ্ণ ঝর্ণাগুলির মধ্যে রয়েছে ইউম সামডোং উষ্ণ ঝর্ণা, রেশি উষ্ণ ঝর্ণা ইত্যাদি।
গ্যাংটকে দর্শনীয় জায়গা
গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় জায়গা হল এম.জি মার্গ বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ। সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো দারুণ দর্শনীয় জায়গা এই এম.জি মার্গ। মাঝে বসার জায়গা, দুই পাশে সুসজ্জিত দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট- সবমিলিয়ে একটা অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশ। এম.জি.মার্গে মহাত্মা গান্ধীর খুব সুন্দর একটি মূর্তি স্থাপিত আছে। গ্যাংটক শহরে রোপওয়ে আছে, উপর থেকে শহরটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে।
গ্যাংটকের আরেকটি দর্শনীয় স্থান হল ছাঙ্গুলেক। গ্যাংটক থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে ১২ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই লেক। শীতকালে ছাঙ্গুলেকের জল জমে বরফ হয়ে যায়। লেকের চারিদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যই অন্যরকম। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা একবার হলেও ইয়াকের পিঠে চড়েন। তবে এই রাস্তায় আসতে হলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে আসতে হয়।
এছাড়াও গ্যাংটকের আরও কিছু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অর্কিড হাউস, বোটানিক্যাল গার্ডেন, এনচে মনাস্ট্রি, রুমটেক মনাস্ট্রি, ডিয়ার পার্ক, গণেশ টক, হনুমান টক, তাশি ইত্যাদি জনপ্রিয়।
গ্যাংটক কখন যাবেন
গ্যাংটক ঘুরতে যেতে হলে বর্ষা কিংবা শীতকাল পরিহার করে শরৎ ও বসন্তকালে যাওয়াই ভালো। গ্যাংটকে মার্চ থেকে এপ্রিল এই দুইমাস বসন্তকাল আর অক্টোবর থেকে নভেম্বর এই দুই মাস হল শরৎকাল। এছাড়া মে জুনে যখন গ্রীষ্মকাল চলে তখনো গ্যাংটকে সুন্দর পরিবেশ পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন গ্যাংটকে
কম বাজেটের মধ্যে ভালো জায়গায় থাকতে চাইলে রাতপ্রতি দুই হাজার টাকার মধ্যেই ঘর ভাড়া পেয়ে যাবেন। আর যারা এর চেয়েও বেশি খরচ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যেও ব্যবস্থা রয়েছে। কম বাজেটের দর্শনার্থীদের জন্য হোটেল সাগরিকা, হোটেল সাইকৃপা ভালো অপশন। আর যারা একটু বিলাসবহুলভাবে থাকতে চান তারা মেফেয়ার স্পা রিসোর্ট এন্ড ক্যাফেতে আরামে থাকতে পারবেন। এছাড়া নেতাক হাউস, হোটেল সোনম ডেলেক, হোটেল গোল্ডেন প্যাগোডা, আনোলা হোটেল, রয়েল প্লাজা, হোটেল সিলভার লাইন, হোটেল গ্রীন, হোটেল তিব্বত এগুলোতেও থাকেন অনেক পর্যটক।
যেভাবে যাবেন গ্যাংটক
সড়ক, রেল এবং বিমান তিন মাধ্যমেই যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। সড়ক পথে যেতে চাইলে চ্যাংরাবান্ধা-বুড়িমারি বর্ডার হয়ে খুব সহজে শিলিগুড়ি চলে যান। তারপর শিলিগুড়ি থেকে সোজা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবেন গ্যাংটক।
রেলপথে যেতে চাইলে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। গ্যাংটক থেকে স্টেশনটির দূরত্ব ১২০ কিলোমিটারের মত। ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারবেন গ্যাংটক শহরে।
আর বিমানে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে বাগডোগড়া বিমানবন্দরে। গ্যাংটকের সবচেয়ে কাছাকাছি বিমানবন্দর এটিই। শহর থেকে প্রায় ১২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিমানবন্দর, গাড়ি নিয়ে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন গ্যাংটকে।