আমাদের এই পৃথিবীটা যে সত্যিই সুন্দর তা একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়। আদীকাল থেকেই কত অবাক করা আশ্চর্য অদ্ভুত সব বিষয়-আশয়, জিনিসপত্র পৃথিবীতে রয়েছে। এর কোনোটা প্রকৃতি তার আজব খেয়ালে তৈরি করেছে, আবার কোনো কোনোটি মানুষ তৈরি করেছে। শেষ কথা হলো, এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের কাছে আজও বিস্ময়ের, আশ্চর্যের; যে রহস্য আজো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃতির অদ্ভুত সব সৃষ্টি আর মানুষের বিচিত্র খেয়ালে পৃথিবী সবসময়ের জন্যই সুন্দর। মানুষ পৃথিবীতে যেসমস্ত আশ্চর্য রহস্যঘেরা জিনিস তৈরি করেছে তার অনেক গুলোই আজ আর নেই। এর কোনোটা ধ্বংস হয়ে গেছে আবার কোনোটাকে মানুষ নিজেই ধ্বংস করেছে।
বিজ্ঞানীরা মানুষের তৈরি এই সমস্ত আশ্চর্য জিনিসগুলোকে সময়ের হিসেবে কয়েকটি যুগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো, প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ এবং আধুনিক যুগ। আজকে আমরা প্রাচীন যুগের রহস্যঘেরা সেইসব আশ্চর্য নির্মাণের কথাই শুনবো। চলুন তাহলে সেই আর্শ্চয সুন্দর রোমাঞ্চকর প্রাচীন পৃথিবী থেকে খানিক বেড়িয়ে আসি।
অজান্তা গুহা
ভারতের আগ্রাবাদ শহর থেকে ১০০ কিঃমিঃ উত্তরপূর্ব কোণে অবস্থিত এই অজান্তা গুহ। এই গুহাগুলো পাহাড়ের চূড়ার অংশ কেটে তৈরি করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মালম্বিদের তৈরি করা এই বাসস্থানগুলো তৈরি করা হয় ১ম এবং ২য় খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। ৫ম এবং ৬ষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দে এই গুহাগুলোকে বেশ মূল্যবান সম্পদ দিয়ে আরো ঢালাওভাবে তৈরি করা হয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক “William Dalrymple” এর মতে এটি “One of the great wonders of the ancient world”।
নিউগ্রেজ
নিউগ্রেজের আকৃতি বিশাল। UFO আকৃতির বিশাল এই স্থাপনা জেগে উঠেছে আয়ারল্যান্ডে। এই স্থাপনা তৈরি করা হয় নবোপলীয় সময়ে, তা আনুমানিক ৩,২০০ খ্রীষ্টপূর্বে। হিসেবে একটু পটু হলে বুঝেই গেছেন এই স্থাপনার বয়স মিশরের পিরামিডের থেকেও বেশি।
প্রাচীন এই স্থাপনায় রয়েছে পাথরের তৈরি বিশাল একটা দরজা আর পথ। ভিতরে রয়েছে অনেকগুলো রুম। এই ঢিবির মধ্যে রয়েছে পাথরের তৈরি দেয়াল আর সেই দেয়ালে আছে নানা রকমের খোঁদাই। এই স্থাপনা নিয়ে বেশ কয়েকটি লোক কথা প্রচলিত আছে। কেন আর কি কাজে এই স্থাপনা ব্যবহৃত হত তা নিয়ে এখন পর্যন্ত সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তারপরেও এটি যে ধর্মের কাজে ব্যবহৃত হতো এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। এই স্থাপনার কিছু ছিদ্র আছে যার মধ্যে দিয়ে আলো প্রবেশ করে এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করে এর ভিতরে।
ডেরিনকুউ
ডেরিনকুউ বহুতল বিশিষ্ট ভূগর্ভস্ত শহর। এর অবস্থান তুর্কির ডেরিকুউ অঞ্চলে। বহুতল এই শহরের গভীরতা ২০০ ফুট। এই ভূগর্ভস্ত শহর এতটাই বড় যে এখানে ২০,০০০ লোক খুব সহজেই তাদের জীবন স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবে। এ যাবৎ যতগুলো ভূগর্ভস্থ স্থাপনা খুঁজে পাওয়া গেছে তার মধ্যে এটিই সব থেকে বড়।
এই ভূগর্ভস্থ শহর তৈরি করা হয় ৭-৮ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এই স্থাপনা কেন তৈরি করা হয়েছিল তা নিয়ে রহস্য থাকলেও অধিকাংশের মতে এর স্থাপনা হয়েছিল বাইরের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য। বিশাল এই শহরের ভিতরে ঢোকার পথ আছে ৬০০টি। এছাড়া বায়ু প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য আছে ১৫,০০০টি ছোট জানালা।
গিজার পিরামিড
মরুভূমির দেশ “মিশর”। প্রাচীনকালে এই মিশরেই গড়ে উঠেছিল এক উন্নততর সভ্যতা। প্রাচীন মিশরে ফারাও রাজবংশের রাজারা একসময় রাজত্ব করতেন । সেসময়ে মিশরের মানুষেরা বেশ কিছু অদ্ভুত বিষয়ে বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো পৃথিবীতে মানুষের বাস খুব স্বল্প সময়ের জন্য, আর মৃত্যুর পরবর্তী জীবন হলো অনন্ত সুখের। তাদের বিশ্বাস ছিলো, মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ যদি অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তারা পরলোকে অনন্ত শান্তির জীবন যাপন করতে পারবে। মিশরীয়রা মৃতদেহ সংরক্ষণের একটি বিশেষ পদ্ধতি আবিস্কার করেছিলো, যাতে করে তারা প্রায় অক্ষত অবস্থাতেই মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে পারতো। এই বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত মৃতদেহকে বলা হয় মমি। এই মমিকে ফারাওরা বিশাল এবং সুরক্ষিত সমাধির মধ্যে রাখতো, যাতে এর সামান্য অংশটুকু ও নষ্ট না হয়। এই সমাধিটি আমাদের কাছে পিরামিড নামে পরিচিত।
পিরামিড দেখতে অনেকটা ত্রিভুজের মতো। এই পিরামিডের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন স্থাপনাটির নাম হলো- গিজার পিরামিড। গিজার পিরামিডকে ফারাও রাজা খুফুর পিরামিডও বলা হয়ে থাকে। এই পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিলো প্রায় ৪৫০০ বছর আগে। গিজার পিরামিড এতোটাই বিশাল যে হাজার হাজার শ্রমিকের এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিলো প্রায় ২০ বছর । মাত্র ২০০ বছর আগেও গিজার পিরামিডই ছিল পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু স্থাপনা। এটি নির্মাণ করতে লেগেছিল প্রায় বিশ লক্ষ পাথরের টুকরো, যার একেকটির ওজন প্রায় বর্তমানের একটি গাড়ির সমান। প্রাচীন পৃথিবীর আশ্চর্যগুলোর মধ্যে এই স্থাপনাটিই এখনো টিকে আছে পৃথিবীতে।
ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান
যেকোনো বাগানে গিয়ে বিভিন্ন রঙের ফুল, প্রজাপতি এসব দেখতে কার না ভালো লাগে? আর বাগানটি যদি হয় মাটি থেকে উঁচুতে, অনেকটা উপরে, তাহলে তো কথাই নেই! এরকমই একটি বাগান হলো ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান। আমরা সবাই জানি ইরাক দেশটির অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে মরুভূমি। অনেক দিন আগে এই দেশেই ব্যাবিলন নামে একটি শহর ছিলো। এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। সেই সময় ব্যাবিলন শহরের রাজা ছিলেন নেবুচ্যাডনেজার। তিনি একদিন এক অদ্ভুত পরিকল্পনা করলেন। স্ত্রীর বিনোদনের জন্য মরুভূমির ভিতরেই একটি উদ্যান তৈরির কথা ভাবলেন। কিন্তু মরুভূমিতে গাছ বাঁচানো এক মহা সমস্যার কথা। কারণটা সেখাকার পানির স্বল্পতা। কাজেই স্বাভাবিকভাবে তো সেখানে বাগান তৈরি করা এক কথায় অসম্ভব। এজন্যই রাজা এক বিশেষ পদ্ধতিতে বাগান তৈরির পরিকল্পনা করলেন।
প্রথমেই তিনি পাহাড়ের মতো একটি জায়গা তৈরি করলেন। তারপর এই পাহাড়কে কয়েকটি তলায় ভাগ করে প্রতিটি তলার চারপাশে বারান্দা তৈরি করলেন। এই বারান্দাতেই নানা রঙের ফুল ও শোভবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়েছিলো। এই উদ্যানটি দেখলে মনে হতো যে গাছগুলো সব শূন্যে ভেসে আছে। মরুভূমিতে কোনো গাছ জন্মানো দুঃসাধ্য প্রায়। সেই জায়গায় এমন সুন্দর একটি বাগান তৈরি রীতিমতো আশ্চর্যের বিষয় ছিলো বৈকি। এই বাগানটি অবশ্য অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে কিছু বিজ্ঞানী ব্যাবিলনের এই উদ্যানটির কিছু ভাঙা দেয়াল খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।