ব্যোমকেশ চরিত্র আবীর চ্যাটার্জী
১৯৩২ সালে ‘ সত্যান্বেষী ’ ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর আগমন। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত বাংলা রহস্য সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তিনি। বাংলা সাহিত্যে ‘ গোয়েন্দা ’ কোন চরিত্রের নাম মনে করতে বললে যে কয়টি নাম শুরুতেই আপনার মাথায় আসবে, ব্যোমকেশ বক্সী তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র। ‘সত্যান্বেষী’র পর আরও সুদীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে পাঠকদের একের পর এক মনোমুগ্ধকর গল্প উপহার দিয়ে গেছেন ব্যোমকেশ বক্সীর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে একপ্রকার একপেশে রাজত্ব করেছে ব্যোমকেশ, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর ধারেকাছে কেউ আসতে পারলে তা কেবল সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাই পেরেছে। তবে প্রথমবারের মত পর্দায় সকলের কাছে ব্যোমকেশ এসেছে ১৯৯৩ সালে। বসু চ্যাটার্জীর পরিচালনায় দূরদর্শন চ্যানেলে প্রথমবারের মত প্রচারিত হয় সিরিয়াল ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। এরপর বড়পর্দায়ও এসেছে ব্যোমকেশ, আর টলিউডে সেটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন যিনি, তিনি আবীর চ্যাটার্জী। বাংলার ব্যোমকেশ চিন্তা করলে শুরুতে অবশ্যই ধুতি পাঞ্জাবি পরা আবীরের চেহারাটাই ভেসে উঠবে। প্রিয়লেখার পাতায় আজ থাকছে সেই আবীর চ্যাটার্জীর সাক্ষাৎকার।
অঞ্জন দত্ত পরিচালিত তিনটি সিনেমায় ব্যোমকেশ ছিলেন আপনি। অরিন্দম শীলের ‘হর হর ব্যোমকেশ’ এ সেই ব্যোমকেশকেই কিভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করলেন?
আবীর : ‘ হর হর ব্যোমকেশ ’ আরও অনেক অনেক বিস্তারিত মাত্রায় বানানো। হর হর ব্যোমকেশের ব্যোমকেশ কেবল ঘরে বসেই কেস সমাধান করে ফেলে না। আমার আগের ব্যোমকেশগুলো কথাবার্তা বলত বেশি, এই ব্যোমকেশ সমানভাবে অ্যাকশনেও পারদর্শী। এই ব্যোমকেশ বেশি চটপটে, ক্ষিপ্ত, অ্যাগ্রেসিভ.. একটু মাস্তানি আছে, বেশ রোমান্টিকও বটে! আগের ব্যোমকেশ সিনেমাগুলোতে ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর রোমান্টিসিজমের অভাব ছিল। সময়ের ব্যবধানও আছে একটা। আগে যেই ব্যোমকেশগুলো করেছি, সেগুলো ১৯৬০ এর দিকের। হর হর ব্যোমকেশ ১৯৪৬ সালের। এখানে ব্যোমকেশ সাধারণভাবে ঘুরে বেরায়, কথা বলে। কোন ‘জ্ঞানদাদা’ নয় সে এখানে!
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনার আগের ব্যোমকেশ চরিত্রগুলো ‘জ্ঞানদাদা’ ছিল?
আবীর : হ্যাঁ। ‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’ তে সে অনেক লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিত। হর হর ব্যোমকেশের ব্যোমকেশ সেদিক থেকে আলাদা, শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই বেশি চটপটে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, খালি হাতেই শত্রুদের মোকাবেলা করার সাহস রাখে। বন্দুক কিংবা ছুরি দেখে ভয় পায় না সে। কোন সমস্যা সামলানোর মত উপস্থিত বুদ্ধি তার আছে। ব্যোমকেশ এখানে অনেকটা ঈশ্বরের মত, তার চারপাশে যা ঘটছে তা সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এই ব্যোমকেশের লুকটাও তো একটু অন্যরকম।
আবীর : হ্যাঁ, অন্যরকমই বটে। এই ব্যোমকেশের শার্টের হাতা গুটানো থাকে, চুলে জেল দেয়া থাকে, চিকন ফ্রেমের চশমা পরে। এই ব্যোমকেশ ফ্যাশনেবল, শরদিন্দু বাবুর ব্যোমকেশও কিন্তু ফ্যাশনেবলই ছিল। চুল একটু বড় করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে গত তিনটা ব্যোমকেশের জন্য যে ধরণের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি, তাতে করে আমার আরও কিছু অতিরিক্ত এফোর্ট দেয়ার দরকার ছিল। যাতে করে দর্শক এসে জিজ্ঞাসা করতে না পারে, এই ছবিতে নতুন কি করেছ? আমার মাথায় এটা আগে থেকেই ছিল আমাকে কিছু এক্সট্রা করতে হবে। আমাকে ফিট দেখাতে হত কারণ হর হর ব্যোমকেশে তার বয়স বিশের ঘরের শেষের দিকে। আগের ব্যোমকেশগুলোর বয়স ছিল মধ্য ত্রিশে। ডায়েট করেছি, জগিং রানিং করেছি।
এখন তো যীশু সেনগুপ্তও ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা তাহলে আগের চেয়ে বেশি, কি বলেন?
আবীর : দেখুন আমি ওভাবে চিন্তা করিনা। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিছুই নেই। আমার যদি কিছু প্রমাণ করার থাকে, তবে সেটা আমার নিজের কাছে ও আমার দর্শকদের কাছে। মানুষ তো অনেকে অনেক কথাই বলবে। সমালোচনা অনেকই শুনি, কিন্তু আমি জবাব দেই আমার কাজের মাধ্যমে।
ব্যোমকেশ চরিত্রে যীশুকে কেমন মানাবে বলে আপনার মনে হয়?
আবীর : আমি এখনো কোন ছবি দেখিইনি! কিছুটা স্বার্থপরের মতই শোনাবে, আমি আমার নিজের ছবি ছাড়া আর কোন ছবি দেখিনি। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছে আমি আর যীশু একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছি। আদতে এমন কোন ব্যাপার নেই।
ব্যোমকেশের পাশাপাশি তো ফেলুদাও করছেন। দুটো চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জিং?
আবীর : আমার জন্য এটা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একইসাথে এটা অনেক গর্বেরও, কারণ এর আগে আর কোন অভিনেতাই একসাথে ব্যোমকেশ ও ফেলুদার চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পায়নি। দুটো চরিত্রকে আলাদাভাবে উপস্থাপনের চ্যালেঞ্জটা আমি নিয়েছি।
দুটো চরিত্রের মধ্যে কিছু মূল পার্থক্য আছে, যেগুলো আমি আলাদাভাবেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এখন থেকে সব ব্যোমকেশ ছবিতেই রোমান্টিক দিক থাকবে, যা আমার জন্য সুবিধাই হবে। কারণ ফেলুদায় রোমান্সের কোন ব্যাপার নেই। আবার ফেলুদা একজন সুপারহিরো, ব্যোমকেশ তা নয়। ব্যোমকেশের মত আমি এখন ফেলুদাকেও মোটামুটি জেনে ফেলেছি। তবে ব্যোমকেশ অনেকটা আমার মতই। আমি ব্যোমকেশের মত হওয়ার চেষ্টা করি। তার সততা ও সত্যান্বেষী চরিত্রগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করি। ফেলুদা সুপারস্টার, সেই সুপারস্টারকে এখনো জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি।
হর হর ব্যোমকেশে সত্যবতীর সাথে আপনার একটা চুম্বনদৃশ্য আছে। আপনাকে সেখানে যথেষ্ট সাবলীলও মনে হয়েছে। অভিনয়ের সব দিকই কি বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা আছে নাকি?
আবীর : দেখুন, বাইশে শ্রাবণ, হৃদমাঝারে, এবার শবর, আসব আরেকদিন, রাজকাহিনিতেও আমার চুম্বনদৃশ্য আছে। লিস্ট তো ভালই লম্বা! নায়িকাদের চুমু খেতে দারুণ লাগে তা বলব না, চুম্বনদৃশ্য আছে বলে ওই সিনেমাগুলো করেছি সেটাও কিন্তু না! হর হর ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, স্ক্রিপ্টের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনেই দৃশ্যটা এসেছে। কিন্তু কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকে বলছে, এটা সেই ১৯৪৬ সালের গল্প, এখানে লিপ-লক এল কোত্থেকে! নববিবাহিত একটি দম্পতি চুমু খাবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে! হ্যাঁ, নতুন নতুন দিক তো বাজিয়ে দেখবই। অভিনেতা হিসেবে আমাকেও তো বেড়ে উঠতে হবে।
একটা জিনিস কিন্তু লক্ষণীয়, ব্যোমকেশ ও ফেলুদা বাদে আপনার অন্য ছবিগুলো কিন্তু অতটা সাড়া ফেলছে না। এটা কি আপনার অভিনয়সত্ত্বাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে?
আবীর : হলে গিয়ে ছবি দেখার ভার কিন্তু দর্শকের। দেখুন, ব্যোমকেশ ও ফেলুদা দুটি ব্র্যান্ড, লোকে এগুলো দেখতে আসবেই। আমার অন্য ছবিগুলো নিয়েও আমি আত্মবিশ্বাসী যে ওগুলোও যথেষ্ট ভালো ছবি। এখন দর্শক যদি দেখতে না যায়, সেটার দায় আমি নেব কেন?
যে কাজের অফারগুলো পাচ্ছি, সেগুলো নিয়ে আমি খুশি। অন্য ছবির সাথে ব্যোমকেশ, ফেলুদার তুলনা দিলে তো হবেনা। কিন্তু তার মানে আবার এই নয় যে এই ছবিগুলো ব্র্যান্ড বলেই শুধু ব্যবসা করছে। দুটো মূল চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে। কারণ এই দুটো চরিত্র মানুষের এত কাছের, এগুলো ফুটিয়ে তোলাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং, দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। এই দিকটাকে খাটো করে দেখবেন না দয়া করে।
আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী আছে এখন- যীশু, পরমব্রত, দেব- তাঁদের মধ্যে কার কাজ সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে?
আবীর : ঋত্বিক চক্রবর্তী। আমি ওর অভিনয়ের ভক্ত। পরমও খুব ভালো করছে। আর এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমি যীশুকেও অভিনন্দন জানাতে চাই। কারণ ব্যোমকেশ চরিত্রে মানিয়ে নেয়াটা সত্যিই অনেক কঠিন ছিল।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া ডট কম অবলম্বনে