ফেসবুকের ফিচারে এসেছে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন। এখন থেকে ব্যবসায়িক প্রচারণা কিংবা ব্র্যান্ডিংয়ের পোস্টের পরিবর্তে আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের পোস্টের উপর বেশি গুরুত্ব দেবে ফেসবুক। খবরটি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য স্বস্তির সুবাতাস বয়ে আনলেও ব্যবসায়ীদের কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন থেকে কাছের বন্ধুদের ম্যাসেজ আর ছবি দেখতে যেন কোনো কসরত করতে না হয়, সে ব্যবস্থাই করবে তারা। “More meaningful social interactions” বা আরও অর্থবহ সামাজিক যোগাযোগের পথ সুগম করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে তারা। একদিকে থেকে এই উদ্যোগকে যেমন সাধুবাদ জানাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা, অপরদিকে ফেসবুক পেজের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা উদ্যোক্তারা পড়ে গেছেন দুশ্চিন্তায়। তাদের ওয়েবসাইটের প্রচারণা চালানোর প্রধান ভরসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।
ফেসবুকের সহ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ এই উদ্যোগটিকে ‘মেজর চেঞ্জ’ বা বিশাল পরিবর্তন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, নিউজফিড জুড়ে ব্যবসায়িক প্রচারণায় ভরা স্পন্সর্ড সব পোস্ট, ভিডিও আর ছবি দেখতে দেখতে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন ব্যবহারকারীরা। তাদের কাছ থেকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর না পেয়ে ফেসবুকের নিউজফিডকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় হাত দেন তারা। বন্ধুদের পোস্ট পড়ার চেয়ে কিংবা ছবি দেখার চেয়ে স্পন্সর্ড বিজ্ঞাপন কোনোভাবেই ইউজারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না, কথাটি মাথায় রেখেই পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
জাকারবার্গ নিজেই বলেছেন, এই পরিবর্তনের ফলে হয়তো সাধারণ মানুষের মধ্যে ফেসবুকে সময় কাটানোর প্রবণতা কমে যাবে। বিশেষ করে যাদের বন্ধু সংখ্যা কম, তারা বেশ বিপাকে পড়ে যাবেন। খোদ ফেসবুকের ব্যবসায়ও লাল বাতি জ্বালিয়ে দিতে পারে এই পরিবর্তিত নিউজফিড। তবে বুস্ট পোস্টের পরিবর্তে সত্যিকার অর্থে যারা যে পেজের তথ্য পেতে চান, সেই ব্যবহারকারীদের কাজে লাগিয়ে কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদে ভালো ব্যবসা করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাকারবার্গ।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউজফিড ভরা বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন, মিডিয়ার সংবাদ কিংবা ভিডিও দেখতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না ব্যবহারকারীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রধান উদ্দেশ্য যেখানে হওয়া উচিৎ আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করা, সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞাপন বরং ইউজারকে আরও একাকী করে তোলে। কাজেই এক্সপ্লোর ফিড ব্যবহার করে কেবলমাত্র বিজ্ঞাপন দেখার আলাদা একটি অপশনের পাশাপাশি কাস্টমাইজ করে শুধুমাত্র কাছের বন্ধুদের ম্যাসেজ আর পোস্ট দেখার ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছে। নিউজফিডকে দু’ভাগে ভাগ করে কমার্শিয়াল পোস্টগুলোকে প্রধান নিউজফিড থেকে পৃথক করে দেয়া হয়েছে। সব পোস্ট একেবারে ডিলিট না করে আস্তে আস্তে আলাদা করার উদ্যোগ নিচ্ছেন জাকারবার্গ। “আপনাদের পছন্দসই প্রোডাক্ট দলের সাথে পরিচিতি ঘটিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য”, জানিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ।
গত বছর থেকে ফেসবুকের এ নতুন প্রক্রিয়াটি টুকটাক করে চালু হলেও নতুন এই নিউজ ফিড পুরোপুরিভাবে কার্যকর হতে আরো কয়েক মাস লেগে যাবে বলে জানান তারা। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ফেসবুকে অসংখ্য ভুয়া ও মিথ্যাচারপূর্ণ কনটেন্ট আর ছবি প্রকাশের পর ফেসবুককে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ও ক্রেমলিন ভিত্তিক অসংখ্য ভুয়া ট্রল ছাড়ার ফলে সেটা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলেই ফেসবুক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ফেসবুকের প্রায় দুই বিলিয়ন ব্যবহারকারীর উপর এই প্রোপাগান্ডা চালানোর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে তা বুঝতে বাকি নেই কারো।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্ক জাকারবার্গ বলেন, বাবা হিসেবে ওয়েবসাইটটির মান উন্নয়ন করা তার নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। “ম্যাক্স আর আগস্ট (জাকারবার্গের দুই মেয়ে) যেন বড় হয়ে বাবার আবিস্কারে গর্ববোধ করে, সে পৃথিবীর ভালোর জন্য কিছু করে গেছে বলে মনে করে, সেই কথা মাথায় রেখেই এই উদ্যোগ নিয়েছি,” জানান জাকারবার্গ।