যদি বলা হয় গ্রীক অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের ভিতরে সবচেয়ে অজনপ্রিয় ছিল কে? সবার আগে যার কথা মনে পড়বে, সে হলো অ্যারিস। অ্যারিস এমন এক দেবতা, যাকে মর্ত্যের মানুষ থেকে শুরু করে দেবতা পর্যন্ত কেউই পছন্দ করতে পারতো না। গ্রীক দেবতারা এমনিতেই মানবিক দোষ-গুণে ভরপুর; তার উপরে অ্যারিস ছিল ঝগড়াটে, যুদ্ধবাজ, ছিচকাঁদুনে এক দেবতা। কোনো কারণ ছাড়াই মারপিট বাঁধানো, রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলা, এমনকি কাপুরুষের মত যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া – সব আজেবাজে “গুণ” ছিল এইরিসের ভিতর। এমন দেবতাকে কারোরই পছন্দ হবার কথা না।
অ্যারিসকে প্রাচীন গ্রীকরা যুদ্ধের দেবতা বলে মনে করতো। অলিম্পিয়ান দেবতাদের ভিতরে হোমার তার ইলিয়াডে এইরিসের কথাই সবচেয়ে কম বলেছেন। যাও বা বলেছেন, সেটা কোনো দেবতার জন্য সম্মানজনক কিছু না।
অ্যারিস দেবরাজ জিউস আর ফার্স্ট লেডি হেরার প্রথম সন্তান। শুধু এই কারণে হলেও এইরিসের যতটা ভালোবাসা, আর আদর পাবার কথা ছিলো, তার কিছুই সে পায়নি। যুদ্ধের দেবতা হবার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, জন্ম থেকেই এইরিসের ভিতরে দাঙ্গাবাজ স্বভাব চরিত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলো। এমন এক বাচ্চাকে চিন্তা করুন, যাকে সামলাতে বাপ মায়ের জান বের হয়ে যাচ্ছে, কোলে নিতে গেলে লাথি ঘুষি মেরে বাপের চোখ মুখের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে, তাকে কোন বাপ পছন্দ করবে? জিউসও পছন্দ করতে পারেননি। হোমারের মতে জিউস এবং হেরা দুজনেই অ্যারিসকে ঘৃণা করতেন। যদিও হেরা মা বলে ঠিক ততটাও অবহেলা দেখাননি , আবার প্রথম সন্তান হিসেবে অ্যারিসের প্রতি যতটা ভালোবাসা থাকার কথা, সেটাও দেখাননি। অ্যারিসের জন্ম নিয়ে অন্য এক মিথও আছে। অনেকের মতে অ্যারিস আসলে জিউসের সন্তান না। এমনকি কেউই অ্যারিসের বাবা না। হেরা জিউসের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নিজে নিজেই গর্ভধারণ করেছিলেন, আর সেই বাচ্চাটাই নাকি অ্যারিস!
অ্যারিসের বাচ্চাকালের প্রথম দিক খুব একটা ভালো যায়নি, এটুকু এতক্ষণে সবার ঠিকঠাক বুঝে যাওয়ার কথা। একেবারে পিচ্চিকালে তাঁকে দুই দানব জমজ ভাই Otus (ওটাস) আর Ephialtes (এফিয়াল্টেস) বন্দী করে লোহার বয়ামের ভিতরে আটকে রাখলো। জিউস আর হেরা যেহেতু অ্যারিসের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, তাই দুইজনের কেউ টেরই পেলেন না যে, তাদের প্রথম বাচ্চাকে অপহরণ করা হয়েছে! দেবতা আর মানুষ – দুই পক্ষের জন্যই আনন্দের বিষয় হতো, যদি এই ব্যাপারটা কেউ টের না পেতো; আর পেলেও অ্যারিসকে উদ্ধার করার জন্য যদি হারমিস নায়কের মত চলে না যেতেন। ভিতরের কাহিনী হলো, দুই দানবের সৎ মা কূটনামি করে হারমিসের কানে তুলে দিয়েছিলো যে, ওটাস আর এফিয়াল্টেস অ্যারিসকে বন্দী করে রেখেছে।
পছন্দ না করলেও, হেরা যখন নিজের বাচ্চার এই অবস্থার কথা শুনলেন, তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না। হেরা হারমিসকে অনুরোধ করলেন, যেভাবেই হোক অ্যারিসকে উদ্ধার করার জন্য। হারমিসও হেরার কথামত উদ্ধার করে এনে মানব-দানব-দেবতা সবার যন্ত্রণা বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। আর ওইদিকে অ্যারিস বেচারাও দীর্ঘ তের মাস ট্যাঁও ট্যাঁও করার পর বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেলো।
এই কাহিনীতে একটা “কিন্তু” আছে! অনেকের মতে অ্যারিস বাচ্চাকালে এই দুই দানবের হাতে আটক হননি। উল্টো দুই দানব ভাই যখন হেরা আর আর্তেমিসকে চেয়ে বসেন, তখন দুই দানব আর দেবতাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সেখানেই অ্যারিস তাদের হাতে আটকা পড়েন। তবে কাহিনী যেটাই হোক না কেন, মানুষ হয়ে অ্যারিসকে কখনো ভয় দেখাতে চাইলে একটা লোহার জার উপহার দিয়ে দেখতে পারেন।
এরপরেই হেরা অ্যারিসের জন্য সবল একজন অভিভাবক খুঁজে বের করলেন, যিনি অ্যারিসকে ঠিক মত দেখে শুনে রাখতে পারবেন, আবার অ্যারিসের হাতে পটলও তুলবেন না। এই অভিভাবক যে ঠিক কী জিনিস ছিলেন, সেটা কেউ জানে না। নিম্ফ (nymph)-ও হতে পারেন, অন্য কিছুও হতে পারেন। তার নাম ছিল থেরো। তিনি অ্যারিসকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন গ্রীসের দক্ষিণের অঞ্চল থ্রাস-এ (Thrace)। পুরো জায়গাটা অতি রুক্ষ, বরফে ঢাকা এক বাজে জায়গা। আপনি-আমি হলে অবশ্যই থাকতে চাইতাম না। কিন্তু অ্যারিসের মত যুদ্ধবাজের জন্য আদর্শ জায়গা ছিলো সেটা। সে এইখানে পাথরের সাথে যুদ্ধ করতো, ছোটখাটো পোকামাকড় পেলে সেগুলোকে কষ্ট দিয়ে মারতো।
অ্যারিসের জন্য এই দিনগুলো একেবারে যথার্থ ছিলো। সে যতই বড় হচ্ছিলো, তার রক্তপিপাসাও তত বেড়ে যাচ্ছিলো। একটু বড় হয়ে যাবার পর থেরো বুঝলেন, একে সামলে রাখা তার কম্মো নয়। যেখানকার জিনিস, সেখানে ফেরত দিয়ে আসাই ভালো। তাই, অ্যারিস আবার তার মা বাবার কাছে ফিরে গেলো। তবে এইবার তাঁকে অলিম্পিয়ান দেবতা হিসাবে বরণ করে নেওয়া হলো। অ্যারিস যে শুধু যুদ্ধের দেবতা, তাই নয়; সে একই সাথে শক্তি, এবং পুরুষত্বের দেবতাও বটে! এই অ্যারিসই অন্য দেবতাদের সাথে গায়ে পড়ে যুদ্ধ লেগে যখন গো-হারা হারতেন, তখন কাপুরুষের মত পালিয়ে যেতেন।
অ্যারিস তার প্রথম কাপুরুষত্ব দেখান যখন ঝড়ের দানব টাইফিয়াস (Typhoeus)-এর সাথে দেবতাদের যুদ্ধ লেগে গিয়েছিলো। তবে অ্যারিসের মহাকাব্যিক মাত্রার কাপুরুষত্ব দেখা যায় ট্রয় যুদ্ধে। ট্রয়ের যুদ্ধে অ্যারিস মানুষের হাতে আহত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে মাউন্ট অলিম্পাসে চলে যায়। সেখানে গিয়ে জিউসের কাছে ছিঁচকাঁদুনে কান্না শুরু করে। একে তো জিউস তাঁকে পছন্দ করতেন না, তার উপর তার বড় ছেলে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে এসে বাচ্চাদের মত কান্না করছে – এই জিনিসটা জিউসের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। অডিসিতে হোমার উল্লেখ করেছেন, কিভাবে রেগে যাওয়া জিউস অ্যারিসকে কথা দিয়ে প্যাঁদাচ্ছিলেন! সবচেয়ে নরম যে কথা জিউস বলেছিলেন সেটা হলো, “ছেলে হিসাবে আমি তোমাকে ঘৃণা করি, এই অলিম্পাসে তুমি আমার পাশে বসারও যোগ্য না”।
অ্যারিসের সাজপোষাকের ব্যাপারে কিছু বলা দরকার। অ্যারিস সবসময় যুদ্ধের সাজে সেজে থাকতো। যুদ্ধের ময়দানে তার পরনে থাকতো স্বর্ণের বর্ম। তার প্রিয় অস্ত্র ছিল ব্রোঞ্জের বর্শা। তার ঢালে ভরে থাকতো রক্ত। এই সময় অ্যারিসকে দেখলে মনে হয়, তার চোখ থেকে বুঝি আগুন বের হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে অ্যারিসের এই রূপ ছিল ভয়াবহ! এই কারণে মরণশীল মানবরা তার সাথে লাগতে সাহস পেত না।
গ্রীক মিথে বিয়ে না করাটা বেশ অদ্ভুত! অ্যারিস এই অদ্ভুত কাজটাই করেছিলো। তবে আশেপাশে প্রেমের আধিক্যের কারণে অ্যারিস নিজেকে রোমান্স থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। তার অনেকগুলো প্রেমের ভিতরে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো – ভাইয়ের বউ আফ্রোদিতির সাথে প্রেম ভালোবাসা। জ্বি হ্যাঁ, সেই যুগেও দেবর-ভাবীর পরকীয়া ছিলো।
বিবাহিত জীবনে আফ্রোদিতি ছিলো দেবতা হেফাস্তুসের (Hepheastus) বউ। ভালোবাসার দেবী, রূপে গুণে অতুলনীয় আফ্রোদিতি নিজের ইচ্ছায় কামার দেবতা ও কারিগর হেফাস্তুসকে বিয়ে করেনি। জোর করে বিয়ে দেবার কারণে হেফাস্তুসের প্রতি তার অনুরাগ কখনোই ছিলো না। তার ওপর হেফাস্তুস ছিলেন কুৎসিত। আফ্রোদিতি আবার সৌন্দর্য নিয়ে একটু অহংকারী! তাই, আফ্রোদিতি প্রেমে পড়ে গেলেন হ্যান্ডসাম ব্যাচেলর অ্যারিসের। অ্যারিসও সুযোগ বুঝে ভাবীর সাথে তার প্রেম চালিয়ে গেলো।
তাদের দুজনের এই প্রেম কাহিনী প্রথম ধরা পড়ে সূর্য দেবতা হেলিওস-এর ছেলে Alcinous-এর কাছে। সে সোজা গিয়ে হেফাস্তুসের কাছে তার বউ আর ভাইয়ের কাহিনী বলে দেয়। হেফাস্তুস খুবই সূক্ষ্ম আর অদৃশ্য লোহার জাল বুনেন। পরের প্রণয় অভিসারে এই জালে আটকা পড়ে যায় অ্যারিস আর আফ্রোদিতি কিন্তু এইখানেই শেষ না। কামার দেবতা তার বউয়ের আর ভাইয়ের কাহিনী দেখানোর জন্য সব অলিম্পিয়ান গডদের ডেকে আনেন। দেবীরা ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ওই অবস্থা দেখলেও দেবতাদের অবস্থা ততটা সুবিধাজনক ছিলো না। একে তো আফ্রোদিতি অসাধারণ সুন্দরী; তার ওপর নগ্ন! আবার এই দেবতাদের অনেকেই আফ্রোদিতিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে অ্যারিস সোজা চলে গেলো তার বাচ্চাকালের বাসস্থান থ্রাসে। এই কাহিনীর সারমর্ম একটাই – অ্যারিস সব সময় পালিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করে।
অ্যারিস আর আফ্রোদিতি ধরা না পড়েই বহুদিন তাদের প্রেমকাহিনী চালিয়ে গিয়েছিলেন। ফলাফল – আফ্রোদিতির গর্ভে অ্যারিসের বেশ কিছু সন্তান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কামদেবতা Eros (যে কিনা কিউপিড নামেই বেশি পরিচিত), ভয়ের দেবতা Phobos, আর আতংকের দেবতা Deimos । তাদের মেয়ে হারমোনিয়া ছিলো সুরের দেবী। ডিমোস আর ফোবোস হল পুরাই বাপের ছেলে। অ্যারিস যখন যুদ্ধের ময়দানে যেতেন, তার এক পাশে থাকত ডিমোস, আরেক পাশে ফোবোস। তাদের প্রধান কাজই ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভয়, আতংক, আর হতাশা তৈরি করা।
এই নামগুলো কিন্তু শব্দের উৎপত্তিবিদ্যা জানার জন্য বেশ জরুরি। আজও কিন্তু যৌনতাময় বোঝানো হয় Erotic দিয়ে, Phobia দিয়ে বুঝায় ভয়, Demon শব্দের অর্থ রাক্ষস, আর Harmonic মানে সুরেলা। অ্যারিসের বিখ্যাত বাচ্চাকাচ্চার ভিতরে আছে এমাজন নারীরা। এরা বিখ্যাত ছিলেন তাদের তীর ধনুক চালনার দক্ষতার জন্য। আজও Amazon শব্দের অর্থ নারী যোদ্ধা।
অ্যারিসকে পছন্দ না করলেও কেউ তার বিরাগভাজন হতে চাইতো না। প্রাচীন গ্রীক সমাজে যেভাবে সবাই অন্য দেবতাদের পূজা করতো, তাদের জন্য মন্দির বানাতো, অ্যারিসের জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। শুধু তারা লক্ষ্য রাখতো, অ্যারিসের মত বদের হাড্ডি যেন রেগে গিয়ে যুদ্ধ না বাঁধিয়ে দেয়। গ্রীক সমাজে তাই অ্যারিসকে নিয়ে তেমন মন্দির বা উপসানালয় দেখা যায় না। তবে স্পার্টার অধিবাসীদের কথা আলাদা। তাদের কাছে অ্যারিস ছিলো খুবই পূজনীয় এক দেবতা। অবশ্য স্পার্টানরাও অ্যারিসের মত যুদ্ধবাজ! সেই সময় গ্রীকদের সেরা যুদ্ধবাজ গোত্র ছিলো এই স্পার্টানরা। 300 নামের মুভিটা নিশ্চয়ই দেখেছেন! তাদের কাছে যে অ্যারিস পছন্দের হবে, সেটা কি খুব বেশি অবাক করার মত কিছু?
রোমান মিথে অ্যারিসের সমতুল্য দেবতা হলেন মার্স। তবে রোমান মিথে মার্সকে ততটা নেতিবাচক চরিত্রে দেখানো হয়নি। মার্সকে মনে করা হতো রোমান দেবরাজ জুপিটার ও জুনোর সন্তান হিসাবে। তবে মার্স ছিলেন যথেষ্ট পূজনীয়। রোমান মিথে তাঁকে মনে করা হয় রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।