১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালিদের উপর নারকীয় হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল তখন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী লেয়ার লেভিন ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের প্রথম সন্তানকে বরণ করার জন্য তাঁর দেশে উদগ্রীব হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন।
ইতিমধ্যে লেভিন জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও শরণার্থীদের দুর্দশার কথা। এছাড়াও মধ্য নিউইয়র্কে ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। মাকিন এই চলচ্চিত্র পরিচালক তখন শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি বানানোর পেশা ও নেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
শর্ট ফিল্ম ও ডকুমেন্টারির মাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি সহিসংতার দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে তিনি মনস্থির করলেন এবং চুপচাপ বসে না থেকে স্ত্রীকে অসুস্থ অবস্থায় একা রেখে চলে এলেন পশ্চিম বাংলায়। বাঙালিদের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সেলুলয়েডে ধারণ করার জন্য দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন। এভাবেই লেয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালে কিছু দুর্লভ চিত্রধারন করেছিলেন।
কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই একদিন লেয়ার লেভিন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র ট্রাকটি দেখে ফেলেন এবং সেইদিন থেকেই তিনি এই গানের দলের সঙ্গে ঘুরতে থাকেন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। আর এভাবেই তিনি ধারণ করলেন পাকিস্তানি হানাদারদের সহিংসতার চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, শরণার্থী ক্যাম্পে শরণার্থীদের অবস্থা সম্বলিত ২২ ঘন্টার দূলভ ভিডিও ফুটেজ ও আলোকচিত্র। বেণু ছিলেন একাত্তরের সেই শিল্পী দলের নেতা, লেভিনের প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়বস্তু যে দল। ওই দলে আরও ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য, দেবব্রত চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, শারমিন মুর্শিদ, নায়লা খান, লুবনা মারিয়াম, লতা চৌধুরী ও দুলাল চন্দ্র শীল।
লেভিনের আশা ছিল, এই ২২ ঘন্টার ধারণকৃত ফুটেজ দিয়ে পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথা বিশ্ববাসীর কাছে জানাতে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য বা যোগান না পাওয়াতে তাঁর এই আশা তিনি পূরণ করতে পারেন নি। আমেরিকান নাগরিক হওয়ায় লেয়ারকে মুখোমুখি হতে হয় সীমাহীন প্রতিকূলতার। যুক্তরাষ্ট্র তখন যুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। তাই তরুণ ওই খেয়ালি মার্কিন নির্মাতাকে নিয়ে নানা রকম সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ভারতীয় প্রশাসনের অনেকের সন্দেহ জাগে, লেভিন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চর হতে পারেন। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে লিয়ার লেভিন ভারত ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁর ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের বিজয়মুহূর্তের সাক্ষী হবেন। সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার লেয়ার লেভিনকে দেয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
লেয়ার লেভিন যে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন, সেটার নাম তিনি ঠিক করেন ‘জয় বাংলা’। নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন। নয় মাস ধরে সম্পাদনার পর প্রায় ৭২ মিনিটের ছবিটি যখন পরিবেশকদের দেখানোর জন্য প্রস্তুত করেন, তত দিনে এর সংবাদমূল্য শেষ। যুদ্ধ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মার্কিন দর্শকদের জন্যও ছবিটির কোনো আবেদন আর বাকি নেই। এরই মধ্যে হয়ে গেছে অনেক ধারদেনা। তাই লেভিন আবার ফিরে যান বিজ্ঞাপন নির্মাণের পেশায়। কিন্তু সযত্নে ফুটেজগুলো তিনি রেখে দেন তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে।
এরপর ১৮ বছর পার হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯০ সালে লেয়ার লেভিনের সন্ধান পান বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। তাঁরা সেই ভিডিও ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন লেয়ার লেভিনের কাছ থেকে। লেয়ার লেভিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যা করতে তাই করেছে মাসুদ দম্পতি। সেই ফুটেজের উপর ভিত্তি করে লেখা হয় চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট। লেভিনের ফুটেজে যাদের গান গাইতে দেখা গেছে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সেইসব শিল্পীদের একত্র করে গানের নতুন অডিও রেকর্ডিং করা হয়। প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে করা হয় শব্দ সংযোগ। অবশেষে দীঘ পাচঁ বছরের চেষ্টার ফলে ১৯৯৫ সালে মাসুদ দম্পতি তৈরি করেন মুক্তিযুদ্ধের উপর অবিস্মরণীয় প্রামান্য চিত্র ‘মুক্তির গান’। তারপর এভাবেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নতুন শিখা ‘মুক্তির গান’।
তথ্যসূত্রঃ তথ্য জানালা