পাকিস্তানী কয়েদ থেকে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর কোলে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধারই। তিনি সবচেয়ে কম বয়সী বীরপ্রতীক খ্যাত শহীদুল ইসলাম লালু বীরপ্রতীক। মাত্র ১২ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে অস্ত্র পরিষ্কারের কাজও করতেন। এভাবেই অস্ত্র ধরা শেখেন কিশোর শহীদুল। সপ্তাহ খানেক পর মুক্তিযোদ্ধাদলের সাথে ট্রেনিং করার জন্য ভারত চলে যান। ভারতে গিয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে অস্ত্র হিসেবে স্টেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও মাথার ক্যাপ। ট্রেনিংয়ের সময় ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামস শহীদুল ইসলামের নামের সাথে লালু নামটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু।
তুরায় লালু স্টেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহন করে সহযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য টাঙ্গাইলের গোপালপুরের কেরামজানীতে আসেন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোপালপুর থানায় হানাদারদের বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অগোচরে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবেন, শত্রু বলে সন্দেহও করবেনা কেউ, সেজন্য লালুকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে লালু বিকেলে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশে রওনা হন।
থানার গেটের সামনে বট গাছের নিচে যেতেই লালুর গ্রামের এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। সে তখন রাজাকারদের নিয়ে রাস্তা পাহারায় ছিল। লালুকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে শহীদ এত দিন কোথায় ছিলি?’ শহীদ উত্তর দেন, ‘কোথায় আর যাব, চারদিকে শুধু গোলাগুলি, আমার ভয় লাগে, তাই নানা বাড়ি গিয়েছিলাম।’ সে তখন বলে, ‘তুই আমাদের ক্যাম্পে থেকে যা, ওই বাংকারে পাঞ্জাবি সেনাদের চা-টা খাওয়াবি।’ সুযোগ হাতছাড়া না করে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান লালু। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুর পাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। এক সময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত স্থানে গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকেন। তারপর চা-পানি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে দেখে নেন। তিনি তিনটি ব্যাংকার টার্গেট করে নেন, যা সহজেই গ্রেনেডে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে কজন পাকসেনা ঘায়েল হবে তার হিসাবও কষে নেন। একেক ব্যাংকারে ৫ জন, ৪ জন ও ৩ জন করে পাকসেনা রয়েছে। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকারগুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু ছোট হওয়ার কারণে সবার সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন।
লুকিয়ে রাখা গ্রেনেড গুলো নিয়ে এসে সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক ব্যাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড গুলো। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর সেদিনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেন। লালু থানা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি যে ফিরে আসতে পারবেন, সে ধারণা কমান্ডারদেরও ছিলনা।
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে শহীদুল ইসলাম লালু মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাস রচনা করেন। এছাড়া তিনি গোপালপুর, ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। অধিকাংশ সময়ে তিনি পাকবাহিনীর ওপর নজরদারির কাজ করতেন। তারা কোথায় অপারেশন পরিকল্পনা করে সব গোপন খবর জোগাড় করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতেন।অনেক সময় তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী প্ল্যান তৈরি করতেন।
১৯৭৩ সালে তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৪২৫। এই যোদ্ধা ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকাস্থ মিরপুরের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খুব ক্লেশভরেই মরার আগে বলে গেছেন, “আমার থিকা অল্প বয়সী লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে। কিভাবে তুলে! আমি ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ করছি, তারা কত বছর বয়সে করছে? রাজনীতির কারণে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুইকা গেছে, তারা ভাতাও তোলে। আর আমার পোলাপাইন না খাইয়া থাকে। কি করুম, আমি মূর্খ মানুষ। ছোটো লোকের পোলা।” এই ছোট লোকের পোলাদের কারণে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, আর তারাই আজ অবহেলিত।
তথ্যসূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন