বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম তারামন বিবি৷ তারামন বিবি একটি বীরত্বপূর্ণ নাম৷ একই সাথে একটি ইতিহাসের জন্ম দেয়া বীর যোদ্ধা৷ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীদের অধিকাংশ সময় বীরাঙ্গনা হিসেবেই বর্ণনা করা হয়। অথচ নারীরাও যে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সে ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না। এমনই এক নারী যোদ্ধা তারামন বিবির কথা নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন।
তারামন বিবির জন্ম ১৯৫৭ সালে৷ কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে৷ বাবা আবদুস সোবাহান, মা কুলসুম বেওয়া৷ তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে৷ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন নানা ভূমিকায়৷ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আরো একজন বীর নারী ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পান৷ তিনি হলেন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম৷
তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন৷ মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন৷ যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার প্রস্তাব দেন৷ প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এতে রাজি হন নি৷ পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন৷ এরপরই তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তাঁর মা৷ তখন তারামনের বয়স ছিলো ১৪ বছর৷ কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান৷
ডয়চে ভেলের সাথে আলাপচারিতায় নিজের সৈনিক হয়ে ওঠার গল্প শোনান তারামন বিবি৷ এছাড়াও দীর্ঘ নয়মাসের অসংখ্য ঘটনার মাঝ থেকে স্মৃতি হাতড়িয়ে জানান একদিনের সরাসরি যুদ্ধের ঘটনা৷ ঘটনা ছিল ঠিক মধ্য দুপুরের৷ সবাই খেতে বসেছে৷ তারামনকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য বলা হলো৷ তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷ হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গান বোট তাদের দিকে আসছে৷ সবার খাওয়া বন্ধ৷ দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই৷ তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন৷ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷ সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন৷ এরপর তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন৷ অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে,তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান৷
শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়৷ নানা কৌশলে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে সোজা চলে গেছেন পাক বাহিনীর শিবিরে৷ কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন৷ চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷ আর জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য৷
বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। গত আগস্ট মাসে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শ্বাসকষ্ট ও পিঠের ব্যথার কারণে তাঁকে কুড়িগ্রামের নিজ বাড়ি রাজীবপুর থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়। তারামন বিবির ছোট ছেলে আবু তাহের জানান, তাঁর মা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও পিঠের ব্যথায় ভুগছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
কর্তব্যরত চিকিৎসক আশীষ কুমার রায় জানান, তারামন বিবির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও সেবা তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে তারামন বিবি জানুয়ারি মাসে রংপুর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৩১ জানুয়ারি তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যান। দেশমাতৃকার জন্য যারা নির্দ্বিধায় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন, স্বাধীন দেশের স্বাধীনতাভোগীদের এখন সময় এসেছে তাদের জন্য কিছু করার।
তথ্যসূত্রঃ বীর প্রতীক তারামন বিবির অতীত-বর্তমান ও রৌমারী-রাজিবপুরের মুক্তিযুদ্ধ, আব্দুস সবুর ফারুকী।