ভেনিস এবং লিডো শহর দুটির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপ পোভেগ্লিয়া। আর দশটি সাধারণ দ্বীপের মতো নয় এটি। সারাক্ষণ পর্যটকদের ভিড়, বাচ্চাদের কোলাহল, সুখী দম্পতির হাসিমাখা মুখ- এই দ্বীপে এর কোনোটিরই দেখা মিলবে না। এখানে বরং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরতে আসা এক রাতের অতিথি তরুণদের দেখতে পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। তবে তারাও হয়তো অনেকে জানেন না, যে আইল্যান্ড অফ ডেথের নেশায় পাগল হয়ে দূরদূরান্ত থেকে এখানে তারা এসেছেন, তার প্রকৃত নাম ‘পোভেগ্লিয়া’।
ইতালির পোভেগ্লিয়া এমন একটি দ্বীপ, যেটি আইল্যান্ড অফ ডেথ নামে বহুল পরিচিত। এই দ্বীপটির সম্পর্কে কথিত রয়েছে যে, একবার এই দ্বীপে যায় সে আর জীবিত ফিরে আসে না। এর পেছনে রয়েছে একটি ভয়ানক কাহিনী। জানা যায়, কয়েকশো বছর আগে এখানে দেড় লক্ষ প্লেগ রোগীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। সে সময় ইউরোপের তিন জন অধিবাসীর মধ্যে একজন প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, এতটাই মারাত্মক ছিল তৎকালীন সময়ের অবস্থা।
প্লেগ রোগীদের এখানে আনা হতো মেরে ফেলার জন্য। পরে ব্ল্যাক ডেথ (কালো জ্বর) এর সময়েও এই দ্বীপকে একই কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে যখন রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার অসুস্থ মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। ১৯২২ সালে এখানে মানসিক হাসপাতাল তৈরি করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর এটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ার কারণ ছিল ডাক্তার এবং নার্সরা অস্বাভাবিক জিনিস দেখতে পাওয়া। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি মানসিক রোগীরা মৃত প্লেগ রোগীদের আত্মা দেখতে পেতেন।
১৮০০ শতকের শেষদিকে পোভেগ্লিয়ায় রোগীদের নিয়ে এক ধরনের পাগলাটে এক্সপেরিমেন্ট চালান এক পাগল চিকিৎসক। হাসপাতাল নামক যে জায়গাটিতে রোগীদের রাখা হতো, তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সেখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। রোগীদের কথা তো অনেক দূরের ব্যাপার। সেই পাগল চিকিৎসক রোগীদের হাত-পা নিয়ে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করতেন। রোগীদের পুনর্বাসন নয়, মৃত্যুই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। দিনে দিনে তিনি পুরোপুরি উন্মাদে পরিণত হন, এবং হাসপাতাল নামক সেই বিল্ডিংয়ের বেল টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রায় একশো বছর আগে সেই হাসপাতালের স্থাপনাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলেও, পর্যটকরা নাকি এখনো সেখানে ঐ উন্মাদ চিকিৎসকের মরণ চিৎকার শুনতে পান।
হাসপাতাল বন্ধের কয়েক বছর পর পর্যন্ত দ্বীপটি জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। এরপর ১৯৬০ সালে ইতালি সরকার একটি বেসরকারি মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয় পোভেগ্লিয়াকে। দ্বীপের নতুন মালিক তার পরিবারকে নিয়ে কয়েকদিন এখানে সময় কাটান। কিন্তু সেখানে তাদের শিশু পুত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ায় কিছুদিন পর তারাও এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যান। এরপর আরেকটি পরিবার এই দ্বীপটিকে হলিডে হোম তৈরি করার জন্য কেনেন। কিন্তু তারাও একদিন পর এই জায়গাটিকে ত্যাগ করেন। বলা হয় যে, দ্বীপের মালিকের মেয়েকে কেউ কামড়ে দেয়। যার ফলে তাকে ১৪টি ইঞ্জেকশন নিতে হয়। সে যাত্রায় মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার বাবা-মা আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি।
এই সমস্ত ঘটনার পর কয়েকজন বিষয়টিকে নিয়ে তদন্ত করার চেষ্টা করেন। যারা এখানে সত্যতা সন্ধান করতে গিয়েছিলেন তারাও জীবিত ফিরে আসেননি। আর যারা জীবিত ফিরে এসেছিলেন তারা বলেন এখানে প্লেগ রোগীদের আত্মা রয়েছে। এই দ্বীপে রাত কাটিয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি বলেছেন, কোনও এক অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে এই দ্বীপ ছেড়ে দিতে বলেন। সে আরও বলে যে যদি তুমি এখান থেকে না যাও, তাহলে তোমার জীবিত বাড়ি ফিরে যাওয়ার আর কোনো আশাই থাকবে না। ভয়ের চোটে সে রাতেই দ্বীপ ছাড়েন ঐ পর্যটক। কিন্তু এই ভুতুড়ে দ্বীপের সত্যতা এখনও রহস্য হয়ে রয়েছে।
উত্তর ইতালি ভিনিস্বাসী উপহ্রদে অবস্হিত এই দ্বীপে তাই এখন জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সরকার এখানে যাওয়ার ব্যাপারে জনগণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলেদের জালে অনেক সময় মানুষের হাড় উঠে আসে। সব মিলিয়ে পোভেগ্লিয়া হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুপুরী, আর সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাসের কেন্দ্রস্থল।