২০১৪ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট (বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার পুরষ্কার) জিতেছিলেন হামেস রদ্রিগেজ, গোল করেছিলেন ৬ টি। ২০১০ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন থমাস মুলার, করেছিলেন ৫ গোল। ২০০৬ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট যায় মিরোস্লাভ ক্লোসার ঘরে, তিনি করেছিলেন ৫ গোল। আর ১৯৫৮ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট পেয়েছিলেন জা ফন্টেইন। কত গোল করে জানেন? ১৩ গোল!
ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৬ গড়ের মত কিছু রেকর্ড এমন অবিনশ্বর মর্যাদা পেয়ে গেছে, যা ভাঙবে এমন চিন্তা করাটা একটু মুশকিলই। জা ফন্টেইনের ১৩ গোলের রেকর্ডও এতদিনে অবিনশ্বরের মর্যাদা পেয়েই গেছে। ১৪ টি বিশ্বকাপ পার হয়ে গেলেও এখনো যে ফন্টেইনের রেকর্ড ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছে!
সাম্প্রতিক সময়ে ফন্টেইনের সবচেয়ে কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফেনোমেনন রোনালদো। ২০০২ বিশ্বকাপ জেতানোর পথে ৮ গোল করেছিলেন ‘দ্য ফেনোমেনন’, সেটিও কিনা ফন্টেইনের চেয়ে ৫ গোল কম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফন্টেইনের রেকর্ড করা তো দূরে থাক, ১৯৫৮ বিশ্বকাপে খেলাটাই কিন্তু নিশ্চিত ছিল না। মরক্কোতে জন্ম নেয়া ফন্টেইনের ক্যারিয়ার শুরু ইউএসএম কাসাব্লাঙ্কা নামের এক ক্লাবের হয়ে। এরপর আসেন ফ্রেঞ্চ ক্লাব নিস এ, সেখান থেকে রেইমসে। বিশ্বকাপে যেই রেমন্ড কোপার সাথে জুটি বেঁধেছিলেন, মাদ্রিদে যোগ দেয়া সেই কোপার শূন্যস্থান পূরণ করতেই রেইমসে এসেছিলেন ফন্টেইন।
বিশ্বকাপের আগে ২৬ ম্যাচে ৩৪ গোল করে রেইমসেকে জোড়া শিরোপা জেতালেও বিশ্বকাপের দলে জায়গা নিশ্চিত ছিল না ফন্টেইনের। শেষ পর্যন্ত অনেক যদি কিন্তুর পর স্কোয়াডে জায়গা পান, কিন্তু একাদশে জায়গা পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হত রেনে ব্লিয়ার্ডের সাথে।
ফন্টেইনের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে, প্রস্তুতি ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে যান ব্লিয়ার্ড। ব্যস, ফ্রান্স দলে নাম্বার টেন কোপার সঙ্গী হয়ে যান ফন্টেইন। আর এরপর? বাকিটা ইতিহাস!
প্রথম ম্যাচে সামনে প্যারাগুয়ে। তখনকার প্যারাগুয়ে বেশ সমীহ জাগানিয়া দলই ছিল। ফ্রান্সের ৭-৩ গোলে জেতা ম্যাচে ৩ গোল করেন ফন্টেইন। পরের ম্যাচ যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। ফ্রান্স ৩-২ গোলে হারলেও দুইটি গোলই করেছিলেন ফন্টেইন। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারালো ফ্রান্স, ফন্টেইন করলেন ১ গোল।
কোয়ার্টার ফাইনালে সামনে উত্তর আয়ারল্যান্ড, ফন্টেইনের জোড়া গোলে ৪-০ গোলে জিতে সেমিতে ফ্রান্স। সেমিতে ফন্টেইন মুখোমুখি হলেন পেলে, গারিঞ্চা, জাগালো, ভাভাদের নিয়ে গড়া ফেভারিট ব্রাজিলের। ৫-২ গোলে হারলেও ব্রাজিল প্রথম গোল করার পর সমতা ফিরিয়েছিলেন ফন্টেইনই।
সেমিফাইনাল থেকে বাদ পরলেও ফন্টেইনের ঝুলিতে এরই মধ্যে তখন ৯ গোল। ঠিক আগের বিশ্বকাপেই করা স্যান্ডর ককসিসের ১১ গোলের রেকর্ড ভাঙ্গতে তাই দরকার অন্তত ৩ গোল। হাতে আছে একটি ম্যাচ, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি। ৬-৩ গোলে জেতা সেই ম্যাচে ফন্টেইন একাই করলেন ৪ গোল, হয়ে গেলেন এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক!
আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখা যেতে পারে, ফন্টেইনের গোল ১৩ টি না হয়ে ১৬ টিও হতে পারত। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দুইটি নিশ্চিত গোল বারে লেগে ফেরত আসে। আরেকটি পেনাল্টি নিজে না নিয়ে নিতে দেন কোপাকে। আর এই ১৩ গোলের একটিও কিন্তু ফন্টেইনের নিজের বুট পরে আসেনি! সতীর্থ স্টেফান ব্রুয়ির থেকে ধার করা বুট দিয়ে খেলেই বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন ফন্টেইন!
তবে বিশ্বরেকর্ড দিয়ে শুরু করলেও এরপর ক্যারিয়ারটা আর বেশি লম্বা করতে পারেননি ফন্টেইন। ১৯৬০ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সেই পা ভেঙ্গে ক্যারিয়ারে যতি পড়ে যায় ফন্টেইনের। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফন্টেইনের ২১ ম্যাচে ৩০ গোল, ম্যাচপ্রতি গোল ১.৪৩। আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন্তত ৩০ গোল করেছেন, এমন ফুটবলারদের মধ্যে ফন্টেইনের ম্যাচপ্রতি গোলই সবচেয়ে বেশি।
খেলোয়াড়ি জীবন ছাড়ার পর অবশ্য নাম লিখিয়েছিলেন কোচিংয়েও। পিএসজি, টুলুজ এর মত ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন, ফ্রান্স ও মরক্কো জাতীয় দলের ম্যানেজারও ছিলেন তিনি।
মিরোস্লাভ ক্লোসা বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১৬ গোলের রেকর্ড করেছেন ৪ টি বিশ্বকাপ খেলে, রোনালদোও ১৫ গোলের রেকর্ড করেছিলেন ৩ বিশ্বকাপ খেলে। ইনজুরির কারণে এত আগেই ক্যারিয়ার শেষ না হয়ে গেলে কে জানে ১৩ গোলের রেকর্ডটাকে কোথায় নিয়ে থামাতেন ফন্টেইন!