মানুষটার নাম জ্যান পিটার ভ্যালা। তার অপরাধ- শ্বাসরোধ করে বান্ধবীকে হত্যা। হাতের পাঞ্জা দেখলে আপনার মনে হবে প্রমাণ সাইজের একটা ডিনার প্লেট, কাঁধ দেখলে মনে হবে যেন একটা তরতাজা মহিষ শিং বাগিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসছে। জেলখানা থেকে সে তার পরিবারকে ফোন করে জানায়, “আমি খুব শীঘ্র বাবা হতে চলেছি।”
এবার হয়ত আপনি একটু থমকে যাবেন। এমন একজন অপরাধী সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কি করে? তার তো এখন জেলে থাকার কথা, তাই নয় কি? এখানেই একটু ভুল হচ্ছে পাঠক। সে জেলে আছে, শাস্তিও ভোগ করছে। তবে বাবা কে হচ্ছেন?
কে আবার? পিটার।
কি করে?
এখানেই হচ্ছে প্রশ্ন। পিটার যে জেলখানায় আছেন, সে জেলখানায় অপরাধীদের সুযোগ দেয়া হয় ফার্মে কাজ করবার, ফার্মে যেসব পশু রয়েছে, সেগুলোকে দেখাশোনা করবার। ৪২ বছর বয়সী পিটার ভ্যালার দায়িত্বে ছিল একটি গরু দেখাশোনা করবার। তার তত্ত্বাবধানেই গরুটি জন্ম দেয় একটি বাছুরের। খুশিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না এই ‘অমানুষ’ ভ্যালা। পরিবারকে ফোন দিয়ে খুশির খবরটা জানান।
ভ্যালা এমন একটি জেলে তার শাস্তি ভোগ করছেন, যেটির কামরার চাবি তার পকেটেই থাকে। দরজায় কোন সশস্ত্র গার্ড পাহারা দেয় না। এখানকার অপরাধীরা পায় স্কিইং করবার সুযোগ, পায় একটি খামার দেখাশোনা করবার সুযোগ, তাদের দিনরাত গুজরান হয় চমৎকার একটি কাঠের তৈরি ঘরে। এবার হয়ত ভাবছেন এটা আবার কেমন জেলখানা?
পাঠক, এই জেলখানার নাম ব্যাস্টয় প্রিজন। নরওয়ের অসলো থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণে হর্টেন মিউনিসিপ্যালিটির একটি অঞ্চলে ব্যাস্টয় প্রিজন অবস্থিত। অসলো থেকে এর দূরত্ব মাত্র এক ঘন্টার এবং হর্টেন থেকে এখানে যাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে ফেরি। এটি প্রায় ২.৬ স্কয়ার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত এবং এতবড় একটি স্থানজুড়ে মাত্র ১১৫ জন অপরাধী রাখা হয়েছে। খুন, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চোরাচালানী ইত্যাদি বড় বড় সব অপরাধের অপরাধীরা এই জেলখানায় এসে পুরোদস্তুর ‘রাজা’র মত জীবন যাপন করে। আরনে ভার্নভিক নেলসেন, এই জেলখানার গভর্নরের তত্ত্বাবধানে ৬৯জন কর্মচারী কাজ করে। এদের মধ্যে মাত্র ৫-৬ জন রাতে অবস্থান করে ব্যাস্টয় প্রিজনে। কারণ, ১৯৮২ সালে স্থাপিত হওয়া এই জেলখানার উদ্দেশ্য, অপরাধীদের সাথে মানবিক আচরণ করা ও তাদেরকে মানুষ হবার, মনুষ্যত্ব কি তা বোঝার আরো একটা সুযোগ করে দেয়া। এই উদ্দেশ্যে তারা সফলও বলা চলে। অচিরেই এটি পৃথিবীর “প্রথম ইকোলজিক্যাল জেলখানা” হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। ইউরোপে যেখানে জেল থেকে বেরিয়ে অপরাধীদের পুনরায় অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ার হার ৭০%, সেখানে ব্যাস্টয় প্রিজনের অপরাধীদের হার মাত্র ১৬%।
আসুন এবার এই প্রিজনের কিছুটা ইতিহাস জানিঃ
নরওয়েজিয়ান সরকার ৯৫ হাজার ক্রোনারের বিনিময়ে এই দ্বীপটি ক্রয় করেছিল ১৮৯৮ সালে। বর্তমান যে জেলখানাটি রয়েছে, তার আগে এটি ব্যবহার করা হত কিশোর অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে। ১৯০০ সালে সেটি পুনর্গঠিত করা হয়। ১৯১৫ সালের দিকে এসে দেখা গেল যেসব কিশোররা এখানে অপরাধী হয়ে এসেছে, তাদেরকে নানাভাবে উৎপীড়ন করছে নরওয়েজিয়ান মিলিটারী বাহিনী। শুরু হয় মিলিটারী বাহিনীর নিপীড়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে এসব কিশোর অপরাধীদের বিদ্রোহ। ১৯১৫ সালের ২০ মে ৩০-৪০ জন বালক চারজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কি? এই চারজন বালক জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করেছিল এবং তাদেরকে পুনরায় ফেরত আনা হয়েছে। তারা কাজ করার অস্বীকৃতি জানায়, হাতের কাছে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল সেগুলো ফেলে দেয়। টেলিফোন তার কেটে দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দ্বীপের সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যেসকল খামারে তারা কাজ করত, সেগুলো সিগারের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
গার্ডরা যখন এই বিদ্রোহ দমাতে ব্যর্থ হল, তারা মিলিটারীদের ডাকতে বাধ্য হল। প্রায় শ’খানেক মিলিটারীতে ভরে গেল দ্বীপটি। এছাড়া দুটো বিশাল সীপ্লেন, সাবমেরিন এমনকি একটি যুদ্ধজাহাজও এসে যায় এই দ্বীপে। এ যেন ঠিক মশা মারতে কামান দাগা প্রবাদের বাস্তব উদাহরণ। কিছু বিদ্রোহী জঙ্গলে পালিয়ে যায় কিন্তু পরে তাদেরকে আবার ধরে আনা হয়। বিদ্রোহের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় মাত্র কয়েকদিন আগে আসা ১৮ বছরের এক বালককে, যাকে সবাই “জিপসি বয়” হিসেবেই জানত। ১৯১৫ সালের এই বিদ্রোহ কিন্তু ঘটনাটা বন্ধ করে দেয় নি। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এমন টুকটাক বিদ্রোহ হতেই থাকে যতদিন না নরওয়ের মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল এফেয়ার্স ঘটনাটিকে নিজের হাতে তুলে নেয়। ১৯৭০ সালের পহেলা অক্টোবর এই ডিটেনশন ‘স্কুল’কে বন্ধ করে দেয়া হয়।
এরপর থেকে চলে ব্যাস্টয় প্রিজনের সংস্কার। আস্তে আস্তে পুরো জেলখানাটিকে করে তোলা হয় মানবিক এবং অপরাধীদের সাথে করা হয় একদম চমৎকার ব্যবহার। তা না হলে পৃথিবীর এমন কোন জেলখানা আছে বলুন, যেখানে অপরাধীদের দেয়া হয় টেনিস খেলার সুযোগ, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করার ব্যবস্থা, ঝানু শেফের হাতে তৈরি রান্না খাবার ব্যবস্থা? অথচ এই দ্বীপকেই বলা হত নাকি “ডেভিল’স আইল্যান্ড”!
স্যার আপনি কি খেতে চাইছেন?
ফিশ বল খেতে চাই, হোয়াইট সস দিয়ে। সাথে একটু শ্রিম্প থাকলেও ভালো হয়!- ঠিক এভাবেই শেফ ও একজন অপরাধীর মাঝে খাবারের অর্ডার নিয়ে কথোপকথন হয়ে থাকে। সি এন এনের একটি ডকুমেন্টারিতে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল এই গভর্নরকে। অপরাধীদের সাথে এমন ব্যবহার করার কারণ কি? তারা তো এখানে অবকাশ যাপনের জন্য আসে নি। এর উত্তরে তিনি বলেন,
“যদি অবকাশ যাপনের একটু সুযোগ করেও থাকি, সমস্যা কোথায়? আমাদের দেখতে হবে এই মানুষগুলো আবারও খারাপ কোন কাজের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে কি না। যদি আমরা তাদেরকে সেখান থেকে বিরত রাখতে পারি, তবে ক্ষতি কি? আদিম মানুষের মত ব্যবহার করতে চাই না আমরা।” এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাস্টয় প্রিজনের দিনলিপি। আলকাটরায যদি অপরাধীদের জন্য নরক হয়ে থাকে, নরওয়ের এই জেলখানা ঠিক তার উল্টো। অপরাধীদের মাঝে মানবিক বোধ তৈরি করার স্বর্গ এটি।
২০১০ সালে King of Devil’s Island নামে একটি ছবি তৈরি করা হয়। আগ্রহীরা চাইলে ছবিটি দেখে নিতে পারেন। ব্যাস্টয় প্রিজনের ওপরই নির্মাণ করা হয়েছিল এই ছবিটি। ২০১৪ সালে এই জেলখানা “Promoting Human Views and Tolerance” পুরস্কার পায়। এছাড়াও মাইকেল মুর এই জেলখানার ওপর একাধিক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন।
জেলখানা অপরাধীদের জন্য নিশ্চয়ই। তবে তারা যদি নিজেদের সংশোধন করে আবার ভালো মানুষের মত সমাজে ফিরে আসে, সেটিই কি আমাদের কাম্য নয়? হয়ত ব্যাস্টয় কারাগার ঠিক সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন।
(লেখাটি তৈরি করতে সাহায্য নেয়া হয়েছে এই সাইটটির)