কথায় প্রচলিত আছে, যা কিছু রটে তার কিছুতো বটে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি আমরা যে উল্টোটাও সত্যি? কিছু না ঘটলেও যদি সেটা রটানো হয় তাহলে সেটার প্রভাব হয়তো ঘটনার প্রভাবকেও ছাড়িয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে সমাজ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে শুধুমাত্র ধারণা আর কান কথার উপরে, কোন কিছু যাচাই না করেই। নিরপরাধ সেই মানুষটির অবস্থা হয় অনেকটা হান্ট বা শিকারের মতন। এরকম একটি ঘটনার রটনা আর একজন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষের জীবনে তার প্রবল প্রভাব নিয়েই ড্যানিশ সিনেমা ‘জাগতেন – দ্য হান্ট’।
ছবিতে দেখা যায় ডেনমার্কের একটা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম, আর সেই গ্রামের বাসিন্দা লুকাস। সে একটা বাচ্চাদের স্কুলে শিশুদের দেখাশুনার কাজ করে। বাচ্চাদের অনেক পছন্দের মানুষ লুকাস। স্কুলের দিকে সে আসতে থাকলেই সবাই লুকায়, আর গেটে ঢোকামাত্র গায়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাঁধে, পিঠে, হাতে আর পায়ের সাথে লটকানো একগাদা পিচ্চিপাচ্চা নিয়ে সে স্কুলে ঢোকে। সেই গ্রামের মানুষজনের মাঝেও খুব ভালো সম্পর্ক। সবাই লুকাসকে অনেক পছন্দ করে। খুব সুন্দর একটা শুরু দেখে পরবর্তীতে কি অশনি আসছে তা আন্দাজই করা যায় না।
লুকাসের সবচেয়ে ভালো বন্ধু থিও এর মেয়ে ক্লারাও সেই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মেয়েটা বেশ চুপচাপ আর অন্তর্মুখী ধরণের। সে অনেক সময় বাকিদের সাথে না খেলে দাঁড়িয়ে থাকে, নানান বিষয়ে তার বাচ্চাসুলভ কৌতুহল। এই মেয়েটাকেও অন্য সবার মতো লুকাস খুব দেখে শুনে, কোলেপিঠে রাখত। যেটা কেউ জানত না সেটা হচ্ছে মেয়েটা কিছুটা যৌন নিপীড়নের স্বীকার। বাসায় বাউন্ডুলে বড়ভাই তাকে নীলছবির অংশবিশেষ দেখায়। অপরদিকে তার বাবা মায়ের টুকটাক ঝগড়া, এসব নিয়ে সে খুব বিষণ্ণতায় ভোগে। সেসময়ে সে একটু আশ্রয় পায় লুকাসের কাছেই। এখানেই মানব মনের একটা গভীর অন্ধকার অজানা দিক লুকিয়ে আছে। কোন ভালোবাসার ধরন কি সেটা নিয়ে তার হয়তো ধারণা নেই, ছয় বছরের ক্লারা মনে মনে গভীর অনুভূতি লালন করে লুকাসের প্রতি। লুকাস বাচ্চাদের সাথে খেলার সময় সে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বসে। অপ্রস্তুত লুকাস বুঝতে পারে না কি বলবে, তবুও সে ক্লারাকে বোঝায় ঠোটে চুমু শুধুমাত্র বাবা মায়ের জন্য।
এই ঘটনায় ক্লারার খুব আঁতে ঘা লাগে। সে চুপচাপ অন্ধকারে একা বসে থাকে। একসময় পরিচালক তার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে সে বলে সে লুকাসকে পছন্দ করে না, কারণ লুকাস নাকি তাকে তার গোপনাংগ দেখিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে নীলছবির অংশবিশেষ তার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে, সে এমন ভাবে বর্ণনা দেয় যেটা একটা ছয় বছরের বাচ্চার দেয়ার কথা না।
পরদিনই লুকাসকে বরখাস্ত করা হয়। সাইকোলজিস্ট এনে ক্লারাকে পরীক্ষা করা হয়। তার কথার মারপ্যাচে ক্লারা ভয় পেয়ে কিছু সায় দেয়। ততক্ষণে লুকাস যে এই অপকর্ম করেছে সবাই সে ব্যাপারে নিশ্চিত। সিনেমার এই পর্যায়ে আমরা ক্লারার মানসিক অবস্থার দিকে একটু দেখি। সে রাগের মাথায় একটা মিথ্যা বলে ফেলেছে, কিন্তু সেটার পরিণতি তার জানা ছিল না। ব্যাপারটার গুরুত্ব সে যখন বুঝতে পারল তার মনই তার সাথে প্রবঞ্চনা করল। এটাকে বলা হয় কনফ্যাবুলেশান বা অনিচ্ছাকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত মিথ্যা। তার মন তাকে এটাই বোঝাচ্ছে যে সে যা বলেছে সেটাই ঠিক।
এদিকে ছোট্ট গ্রামটিতে এই কথা চাউর হয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। সবাই লুকাসকে চরম ঘৃণা করতে শুরু করল। সামাজিকভাবে তাকে বয়কট করা হলো। সে যেই দোকান থেকে কেনাকাটা করত সেখানে তার আর তার ছেলের প্রবেশে দেয়া হলো নিষেধাজ্ঞা। মাঝরাতে তার বাসায় কারা যেন ঢিল ছুড়ে জানালার কাচ ভেংগে দেয়। এতেই ক্ষান্ত দেয় নি সমাজ, একদিন বাইরে গিয়ে সে দেখে একটা বস্তা, কেউ এসে তার আদরের কুকুর ফ্যানিকে মেরে রেখে গেছে। সংঘবদ্ধ ঘৃণা কতোটা ভয়াবহ সিনেমার এই পর্যায়ে বোঝা যায়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লুকাস যতটা পারে ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করে, এরপরেও একসময় ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলে তার আচরণ অসংলগ্ন হয়ে যায়। তার গার্লফ্রেন্ড পর্যন্ত তাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাপারটি পুলিশকে জানানো হবে। একদিন সকালে সে গ্রেপ্তার হয়,পুলিশ তদন্ত শুরু করে দেয় ।
ক্লারা প্রচন্ড অন্তর্দন্দ্বের মাঝে পড়ে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে সে দেখে মানুষের মার খেয়ে তার প্রিয় লুকাস আংকেল রক্তাক্ত অবস্থায় হেটে যাচ্ছেন। সে সাথে সাথে বাবা মা সহ সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে মিথ্যা বলেছে, আসলে লুকাস আংকেল এরকম কিছু করেননি, করতে পারেন না। বিধি বাম, ক্লারার বাবা মা ধরে নেয় তার অবচেতন মন এই স্মৃতি ভুলতে পুরো ব্যাপারটি ডিনায়াল বা অস্বীকার করছে। তারা ক্লারার কথা মেনে নেয়ার ভান করেন। অপরদিকে লুকাস চারপাশের চাপে পড়ে নিজেও একজন দোষী ব্যাক্তির মত আচরণ করতে থাকে। এখানেই দ্যা হান্ট সিনেমার মূল থিম-মিথ্যা পাপবোধ। নিজেকে লুকাস পাপী ভাবতে শুরু করে। মানবমনের এক বৈশিষ্ট্য হলো এটা কম্পিউটারের মত করে স্মৃতি সংরক্ষণ করে না, এটা অনেকটা উইকিপিডিয়ার মত। যে কোন ঘটনার আলোকে নিজেকে সে নিজেই এডিট করে। অর্থাৎ স্মৃতি পরিবর্তনশীল। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।
গ্রামের বাকি সবাই ভাবা শুরু করে তাদের নিজেদের বাচ্চারাও হয়ত একই ভাবে নিপীড়নের শিকার। তারা সব বাচ্চাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করে। এখানে আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। আমাদের সবার ধারণা বাচ্চারা মিথ্যা কথা বলে না । ব্যাপারটা ঠিক, আবার ভুলও বটে। ছোট বাচ্চারা একটা কল্পনার জগতে থাকে, তারা যেকোন কথা বলার সময় নিজের কল্পনা প্রসূত অনেক কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে বলে। আশপাশের গুঞ্জন শুনে তাদের মনেও প্রভাব পড়ে। তারাও দাবী করতে শুরু করে লুকাস তাদের সাথেও এরকম এরকম করেছে। সবাই তাকে ঘৃণ্য শিশু নিপীড়ক পেডোফাইল ধরে নেয়। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে লুকাসের বিপক্ষে যেতে থাকে। কিন্তু বাচ্চারা যখন কল্পিত বেসমেন্টের কথা বলে, আর পুলিশ যখন দেখল লুকাসের বাসায় কোন বেজমেন্ট নাই তখন মামলাটা দূর্বল হয়ে যায় ।
সিনেমাটি আসলে আমাদের চারপাশের সমাজেরই প্রতিভূ, যেখানে একজন পাপী হোক বা পাপে অভিযুক্ত হোক, তাকে মাঝখানে রেখে গোটা সমাজ জোট বাধে ঠিক হরিণ শিকার বা হান্টের মত। পাপের বিরুদ্ধে্ সবার কতই না অনড় অবস্থান। কিন্তু সেটাও যে পাপ সেটা বোঝার মত মানসিক স্থিরতা কেউ দেখাতে পারে না। লেখাটি এমন একটা সময়ে লেখা হয়েছে যখন বাংলাদেশেই চুরির দায়ে একটা ছেলেকে বেধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা কর- কেন বলা হয় সেটার এক দৃষ্টান্ত এই সিনেমাটি।
সমাজের কাছে লুকাস তার হারানো সম্মান হয়তো কখনোই পুরোপুরি ফেরত পাবে না। শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে তার ভাগ্যে? কিভাবে গোটা সমাজকে সে চ্যালেঞ্জ করবে যে সে নির্দোষ? যেই ক্লারার জন্য এত কাহিনী কি হবে তার প্রতি লুকাসের পরবর্তী মনোভাব? ক্লারাই বা কিভাবে গ্রহণ করবে তার আংকেলকে? জানতে হলে দেখতে হবে ‘দ্য হান্ট’ ছবিটি।
এই ছবির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে লুকাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, কিং আর্থার ও ক্যাসিনো রয়াল খ্যাত মিকেলসেন। অসাধারণ অভিনয়দক্ষতা ছাড়াও মিকেলসেনের আরেকটি ব্যাপার লক্ষনীয়, সেটা হচ্ছে চরিত্রটির সাথে তার মানিয়ে যাওয়া। মিকেলসেনের চেহারা গঠন আকৃতি পাকা ভিলেনের মত। কিন্তু সিনেমাতে তার চরিত্রটি সাধাসিধে ভালো মানুষের। যখন ভিলেনসুলভ কোন অভিনেতাকে কোন সাধাসিধে চরিত্রে অভিনয় করতে হয় তখন তার অভিনয়ের গুণেই হোক বা যেই কারণেই হোক তার প্রতি দর্শকের সহানুভূতি চলে আসে। উদাহরণস্বরুপ আমরা ‘দ্য গ্রিন মাইল’ ছবিটির কথা বলতে পারি। জন কফির বিশাল বপু আর কিম্ভুত চেহারা সত্ত্বেও তার সোজাসিধা ভাব দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। সেরকম ভাবে মিশা সওদাগর, ডিপজল, এ টি এম শামসুজ্জামান বা হুমায়ুন ফরিদীকে খুব সরল চরিত্রে অভিনয় করতে দেখলে স্বাভাবিকভাবে দর্শক নিজের অজান্তে চরিত্রটার প্রতি দূর্বল হয়ে যাবেন। ছবিটিতে আরো দেখা যায় ডেনমার্কের গ্রাম আর গ্রামীণ মানুষের শিকারী জীবনযাত্রা।
দ্যা হান্ট ছবিটি সেরা বিদেশী ছবি ক্যাটাগরীতে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। মিকেলসেন জিতেছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরষ্কার। এছাড়া গল্প, স্ক্রিনপ্লে, সিনেমাটোগ্রাফি আর অভিনয়ের জন্য মোট ৩৬টি পুরষ্কার জিতেছে ছবিটি। আই এম ডি বি তে ছবিটির রেটিং ৮.৩।