টোকিওর এক উপাসনালয়ের সামনে অপেক্ষা করছেন শত শত মুরাকামি ভক্ত। আর কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা করা হবে এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম। নাহ, এবারো হারুকি মুরাকামি জয়ী হলেন না। হলেন কাজুও ইশিগিউরো। নিরাশ হলেন না ভক্তরা। নামটা যে জাপানিজ। করতালির মাধ্যমে স্বাগতম জানালেন তারা নতুন নোবেল বিজয়ীকে। মুরাকামির অপেক্ষার পাল্লাটা আরেকটু ভারি হল, এই যা!
কে এই কাজুও ইশিগিউরো?
কাজুও ইশিগিউরো জাপানের নাগাসাকিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তার বাবা মায়ের সাথে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন, সাথে ছিলেন আরো দু বোন। ইশিগিউরোর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। তার বই The Remains of the Day এর ১৯৯৩ সালের ফিল্ম অ্যাডাপটেশন হয়ত অনেকেরই মনে থাকার কথা। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স। তবে বহু জাপানিজের নিরাশার মাত্রাটা আরো একটু ভারি হয়েছে। শুধু তারাই নয়, সুদূর বাঙাল মুল্লুকেও অনেকেই ধারণা করছিলেন, এবার হয়ত নোবেলটা মুরাকামির ঝোলাতেই যাবে।
তবে ব্রিটিশ লেখক ইশিগিউরো জানান, তিনি একইসাথে প্রচন্ড সম্মানিত বোধ করেছেন এবং “বিস্মিত”ও হয়েছেন। এ বছর সাহিত্যে কে নোবেল পুরস্কার পেলেন, এই খবর যখন চাউর হয়, তিনি ভেবেছিলেন এটা হয়ত কোন ভুল খবর।
The Remains of the Day এবং Never Let Me Go এর লেখক কাজুওর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে দ্য সুইডিশ একাডেমী। তাদের মতে, “কাজুওর বইগুলো লেখা হয়েছে আমাদের জাগতিক চিন্তাভাবনার সাথে কল্পনার এক সম্পর্ক থেকে। প্রচন্ড আবেগিক এক শক্তি থেকে ইশিগিউরোর গল্পগুলো লেখা।”
গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইশিগিউরো বলেন,
“আপনার মনে হতে পারে আমাকে এই খবরটা কেউ হয়ত পঙ্গপালের মত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পরবে, কিন্তু না। কেউই কিছু জানত না।” ইশিগিউরো তার বাড়ির কিচেন টেবিলে বসে ছিলেন, যখন তার এজেন্ট এই সুসংবাদটি তাকে দেয়। বলা বাহুল্য, তিনি প্রচন্ড খুশি, বিস্মিত ও একইসাথে সন্দিহান হয়ে ওঠেন।
“এটা এমন কিছু একটা ছিল, যা আমি আশা করি নি। নয়ত, আমি সকালবেলা চুল আঁচড়ে একদম ফিটফাট হয়ে থাকতাম,” হাসতে হাসতে সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি। “বলতে পারেন, পুরোটাই ছিল একটা হইচই এর মাঝে। আমার এজেন্ট আমাকে ফোন দিয়ে বলল, আমার নাম নাকি নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। চারপাশে আজকাল এত মিথ্যা আর ভ্রান্তিপূর্ণ খবর থাকে যে, কিভাবে কি বিশ্বাস করব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না। সাংবাদিকরা যখন আমার দরজার সামনে ভিড় করতে শুরু করে, তখন বুঝে গিয়েছি আসলেই কিছু একটা ঘটেছে।”
ফ্যান্টাসি ঘরানার এই লেখকের বই নিয়ে ব্রিটিশ কবি অ্যান্ড্রু মোশন বলেন,
“ইশিগিউরোর কল্পনার রাজ্যে আছে প্রচন্ড মূল্যবোধ এবং একইসাথে আপনি হয়ে উঠবেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যাকে সবাই যেন খুব ভালো করে চেনে। এমন একটা দুনিয়া তার, যেখানে একইসাথে রয়েছে ধাঁধা, বিচ্ছিন্নতা, বিস্ময়, হুমকি ও নিশ্ছিদ্রতা।”
মাত্র চার সপ্তাহে ইশিগিউরো শেষ করেছিলেন তার নোবেল বিজয় এনে দেয়া বই The Remains of the Day। মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে স্টিভেনস নামক এক ব্রিটিশ বাটলারের জীবনাচরণ ও তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দ্বন্দ্ব নিয়ে। বইটি শেষ করবার জন্য তাকে কিছু গবেষণা করতে হয়। ব্রিটিশ সার্ভেন্ট, রাজনীতি, বৈদেশিক নানা পলিসি ইত্যাদি নিয়ে পড়াশুনা করতে হয় তাকে। হ্যারল্ড লাস্কির লেখা প্রবন্ধ “The dangers of being a gentleman” পড়ে ভীষণভাবে তাড়িত হন তিনি। ১৯৩০ ও ৫০ এর দশকের ব্রিটিশ গ্রামাঞ্চলের ভাবধারা, মূল্যবোধ, আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন ইশিগিউরো। তবে তিনি মনে করেন বইটি তার জন্য পয়া হয়েই এসেছে। এটি নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা কিংবা হতাশার মধ্যে থাকতে হয় নি তাকে। ১৯৮৯ সালে তার এই বইটি বুকার পুরস্কার লাভ করে।
টম ওয়েইটসের গান “রুবি’স আর্ম” থেকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন ইশিগিউরো। একজন সৈনিকের দুঃখগাঁথা নিয়ে রচিত এই গানটি। সৈনিক তার ঘুমন্ত প্রেয়সীকে ছেড়ে ট্রেনে ওঠার তাড়া। ইশিগিউরো বলেন, গানের মাঝে কোন ধরণের সমস্যা ছিল না কিন্তু কর্কশ আমেরিকান হোবো টাইপের এই গানটি তার মর্ম স্পর্শ করে। গানের এক পর্যায়ে গায়ক বলেন তার অন্তর ফেটে যাচ্ছে। এতটা সুরের লহমায় গাওয়া গান শুনে স্থির থাকতে পারেন না ইশিগিউরো। তিনি মনে করেছিলেন বইটা হয়ত শেষ হয়ে গিয়েছে। আবার পান্ডুলিপি হাতে নিলেন ইশিগিউরো। গল্পের প্রধান চরিত্র স্টিভেনসের মাঝে আনেন আরো কিছু পরিবর্তন, চরিত্রটিকে করেন আরো শাণিত।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা The Conversation নামের থ্রিলার ঘরানার ছবিটির অবদান রয়েছে তার বইয়ের চরিত্র স্টিভেনসের রুপায়নে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা। ইশিগিউরো মনে করেন, জিন হ্যাকম্যানের করা ফ্রিল্যান্স সার্ভেইল্যান্স এক্সপার্ট চরিত্রটি স্টেভেনস দ্য বাটলারের একদম প্রাথমিক মডেল।
অভিনন্দন ইশিগিউরোকে। অভিনন্দন নোবেল কর্তৃপক্ষকে। কাজুও ইশিগিউরো তার লেখনীর মাধ্যমে সুবাসিত করুন এই পৃথিবীকে এই হোক কামনা। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন।
(ফিচারটি করতে সাহায্য নেয়া হয়েছে এই সাইটটির )